করোনার পর ঘুরে আসুন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/05/27/thumb.jpg)
প্রকৃতির একটা নিজস্ব রূপ আছে। আর সে রূপ হলো সতেজতা। যখন প্রকৃতি তার সতেজতা হারিয়ে ফেলে, তখন এটি বিরূপ আকার ধারণ করে। কখনো সিডর, আইলা, ফণীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্লেগ, বসন্ত ও করোনার মতো মহামারি দিয়ে। এগুলো এককথায় বলা যেতে পারে প্রকৃতির প্রতিশোধ। তবে এই করোনাকালে প্রকৃতি তার নিজের রূপে ফিরে এসেছে। আমরা যাঁরা ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করি নদী, পাহাড়, সমতল বা ঐতিহাসিক স্থান, তাঁরা আজ আড়াই মাস হতে চলল ঘরে আছি। আশা করি, দ্রুত এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। তাই করোনাকালের পর কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, তার পরিকল্পনা করে ফেলুন এখনই। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এ দেশের ইতিহাস বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজ এগুলোর খোঁজ দিচ্ছি পাঠককে।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/1.jpg 687w)
লালবাগের কেল্লা, ঢাকা
লালবাগের কেল্লা মোগল আমলের বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন, যাতে একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টিপাথর, মার্বেল পাথর আর নানান রংবেরঙের টালি। লালবাগের কেল্লা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনে এমন বৈচিত্র্যময় সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। লালবাগের কেল্লা পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত। লালবাগের কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/2.jpg 687w)
হাজীগঞ্জ দুর্গ, নারায়ণগঞ্জ
হাজীগঞ্জ দুর্গ নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে হাজীগঞ্জ দুর্গে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। হাজীগঞ্জ দুর্গ আবার খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত। জলদুর্গের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। মোগল সুবেদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপনের অব্যবহিত পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/3.jpg 687w)
শশী লজ, ময়মনসিংহ
মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। তখন গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিলেন রঘুনন্দন। গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ! দীর্ঘ রোগ-যন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও! তাঁর বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন পৃথিবীর মায়া। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তকপুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশী লজ।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/4.jpg 687w)
জৈন্তেশ্বরী, সিলেট
জৈন্তেশ্বরী মূলত সিন্টেং বা জৈন্তা রাজাদের পূজিত দেবতার বাড়ি। জৈন্তার রাজা যশোমানিক ১৬১৮ সালে অত্যন্ত আড়ম্বরে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কালী দেবীর মূর্তিকে এ বাড়িতে স্থাপন করেন এবং বাড়িটি নির্মাণ করেন। রাজা ধনমানিক ১৫৯৬ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়ার অধিপতি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৬০৬ সালে কাছাড় রাজ শত্রুদমন যশোমানিককে মুক্তি দেন। যশোমানিক দেশে ফিরে আসেন ও সিংহাসন লাভ করেন। শত্রুদমনের এই বিজয়ের পর যশোমানিক কোচবিহার গমন করেন এবং কোচরাজ লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যাকে বিয়ে করেন। সে বিয়েতে যৌতুকস্বরূপ ধাতুনির্মিত মূল্যবান একটি দেবমূর্তি প্রাপ্ত হন। দেবী কালীর সে মূর্তিকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে জৈন্তাপুরে নিয়ে মহাসমারোহে জৈন্তেশ্বরী কালী নামে প্রতিষ্ঠিত করেন।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/5.jpg 687w)
বাঘা মসজিদ, রাজশাহী
বাঘা মসজিদ রাজশাহী জেলা সদর থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি ১৫২৩-১৫২৪ সালে হুসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহর পুত্র সুলতান নসরাত শাহ নির্মাণ করেন। মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে। আর ভেতরে রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে চারটি মেহরাব রয়েছে, যা অত্যন্ত কারুকাজখচিত।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/6.jpg 687w)
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, নওগাঁ
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চাকেন্দ্র ছিল।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/7.jpg 687w)
মহাস্থানগড়, বগুড়া
মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৬ সালে এটি সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা হয়। প্রাচীরবেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দ পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/8.jpg 687w)
তাজহাট জমিদারবাড়ি, রংপুর
শত বছরের অমলিন কীর্তি রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি। কালের পরিক্রমায় আমাদের অনেক কীর্তি হারিয়ে গেলেও এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তাজহাট জমিদারবাড়ি। তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্না লাল রায়। তিনি পাঞ্জাব থেকে এসে রংপুরের মাহীগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহীগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা শহর। কথিত আছে, স্বর্ণ ব্যবসায়ী মান্না লাল রায়ের আকর্ষণীয় তাজ আর রত্নখচিত মুকুটের কারণে এ এলাকার নামকরণ হয় তাজহাট।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/9.jpg 687w)
কান্তজিউ মন্দির, দিনাজপুর
ইন্দো-পারস্য ভাস্কর্যশৈলীতে নির্মিত দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির দেশের সবচেয়ে সুন্দর মন্দির। অধিকাংশ স্থাপত্যকর্মীকে পারস্য থেকে আনা হয়েছিল। কালিয়াকান্ত জিউ, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপনের জন্য, তাই মন্দিরের নাম কান্তজিউ, কান্তজি বা কান্তজির। মন্দিরের জন্য এ এলাকা কান্তনগর নামে পরিচিতি পায় এবং সে কারণে পরে মন্দিরটির অপর নাম কান্তনগরের মন্দির হয়ে ওঠে। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তাঁর শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/27/10.jpg 687w)
ষাটগম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট
ষাটগম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। ধারণা করা হয়, ১৫০০ শতাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়। এ মসজিদ বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি; বাগেরহাট শহরকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এই সম্মান প্রদান করে।
তবে ভ্রমণপ্রিয় বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, করোনাপরবর্তী সময়ে যদি ভ্রমণের সুযোগ হয়, তবুও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভ্রমণ করুন। আপনার ভ্রমণের জন্য অন্য কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সব সময় সরকার গৃহীত নিয়মাবলি মেনে চলুন।