নেত্রকোনার তেপান্তরে কয়েক উদয়াস্ত

সময় তখন প্রায় ন'টা। সোনালী আভায় ফুটে উঠেছে একটা সুন্দর সকাল। মহাবিশ্বের সবল চাকায় এই সুন্দর সকালের যাত্রা পশ্চিমে। ততক্ষণে আমাদেরও যাত্রা শুরু, তবে পশ্চিমে নয়, উত্তরে। ঘুরতে শুরু করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৩ তম আবর্তনের প্রথম বার্ষিক মাঠ পর্যবেক্ষণ ও গবেষনা ভ্রমনে যাবার গাড়ির চাকা। হাওয়ার দেয়াল ফুঁড়ে শো শো শব্দে সীমান্ত অঞ্চল নেত্রকোনার দিকে এগিয়ে চলছে আমাদের যাত্রার রথ। ক্যাম্পাসের নৈঃস্বর্গ ছেড়ে এবার একটু ঘুরে আসা যাক অচেনা পৃথিবীর কোন এক অচেনা প্রান্তরে, অচেনা জনসমুদ্রে।
গবেষণাধর্মী শিক্ষায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সব সময়ই এগিয়ে, এর মধ্যে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অবদান এবং অবস্থান প্রনিধানযোগ্য। ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে হাতে কলমে শেখার জন্য চষে বেড়াতে হয় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল, মরুভূমি, নদী, সাগর, কিংবা পর্বতে, মানুষ থেকে মানুষে, তাদের পরিবেশের একেবারে কাছে। সেই কারণেই বিভাগটি প্রত্যেক বছরই প্রত্যেক আবর্তনের জন্য পৃথক পৃথক মাঠ পরিদর্শন ও গবেষণা ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে, যা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্যই বাধ্যতামূলক।এই সফরের জন্য সাধারণত প্রাকৃতিক এবং ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানকেই নির্ধারণ করা হয়। সফরের সময়কাল থাকে পাঁচ থেকে সাত দিন। নেত্রকোনার উপর দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদী, যা নেমে এসেছে অদূরের গারোপাহাড় থেকে, তার উৎপত্তি, তীরবর্তী বিভিন্ন ভূমির উৎপত্তি, গঠণ বিন্যাস, নমুনা সংগ্রহ, নির্ধারিত অঞ্চলের প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও সম্পদ সহ সেই এলাকার পরিবেশ ও মানুষের জীবনধারা জানার জন্য অর্থাৎ হাতে কলমে ভূগোল বিষয়ক জ্ঞান অর্জনই ছিলো এই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য। তার ফাঁকে গারোপাহাড় ও বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড় ভ্রমণ তো থাকছেই। এশিয়ার অন্যতম সেরা ভূগোলবীদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামছুল আলম স্যারের নেতৃত্বে আমরা ৪৩ তম আবর্তনে প্রায় ৮৩ জন শিক্ষার্থী এই ভ্রমণে অংশ নেই।
আমাদের সাথে ছিলেন প্রখ্যাত সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.সুভাষ চন্দ্র দাস স্যার। তাছাড়া আরোও ছিলেন মেহেদি স্যার, শ্যামল স্যার, ইবাদুল্লাহ স্যার, আনোয়ারুল স্যার এবং ফিল্ড এসিস্ট্যান্ট নেছার আলী ভাই। বেলা বিকেল প্রায় ৩.৫০ নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই বিরিশিরিতে আমাদের ভাড়া করা গেস্ট হাউজে। একেবারে গ্রামীন, সুন্দর ও মনরোম পরিবেশ, যা আমাদের থাকার জন্য হয়ে উঠে একটি সুন্দর স্থান। ভ্রমনের ক্লান্তি একটুও কাবু করতে পারেনি আমাদের। পুরো বিকেলটা কেটেছে স্যারদের সাথে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলে। তারপর রাতের খাবার শেষে স্যারের ব্রিফ। মধ্যরাত অবধি দুষ্টুমি, গাড়িতে মজা করা এবং সবার হা করে ঘুমানোর দৃশ্যটা মনে পড়ে বেশ হাসি পাচ্ছিলো। স্যারদের সাথে কার্ড খেলাও জমে উঠে বেশ। অতঃপর আমাদের নিদ্রাবাবু আসিলেন!
স্যারদের কড়া নির্দেশ ভোরে উঠতে হবে, হলোও তাই। দ্রুত নাস্তা সেরে সব যন্ত্রপাতি সমেৎ হাঁটা শুরু সোমেশ্বরীর তীরে। যা ভেবেছিলাম তা নয়, পুরো নদীগর্ভ চর, মাঝে মধ্যে একটু আধটু পানি। সকাল থেকে দুপুর কড়া রোদে পুড়ে সোমেশ্বরীর জন্মপ্রক্রিয়া উৎঘাটন, ক্লাইনোমিটার দিয়ে ঢাল নির্ণয়, স্কেচ অঙ্কন, পানির ঘনত্ব নির্ণয় করতেই গেলো। কি কর্মযজ্ঞ রে বাবা! সোমেশ্বরী যদি বুঝতে পারতো তবে বিরাট আকারে ধন্য হতো। কি বিরাট ব্রীজ! তবে নড়বড়ে, ট্রাক গেলেই নড়ে ওঠে। প্রথম তো ভেবেছিলাম, এই বুঝি ভূমিকম্প হলো। নদীকে ঘিরেই এলাকার মানুষগুলোর জীবন। না, মাছ ধরা নয়, নদীর বালু খুঁড়ে কেউ কেউ বের করে আনছে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা কয়লা। কেউ কেউ ট্রলার দিয়ে তুলছে বালু। নদীর বালু খুঁড়ে পানি তুলে খায়ও এরা। আমিও খেলাম, একটু না খেলে কি হয়! দুপুরের খাবার সেরে আবার যাত্রা আশ্রয়ন প্রকল্পে। গেলাম সেখানে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হলো তাদের সাথে। এলাকার মানুষগুলো দরিদ্র, তবে অতিমাত্রায় ভদ্র। ভদ্রতার খাতিরে আমাদের চা বিস্কিট খাওয়াতে একটুও কার্পণ্য করেনি! এই অঞ্চলের গারো সম্প্রদায় এবং বাঙ্গালী মুসলমানদেও সৌহার্দ্যপূর্ণ বসবাস আমাদের দেশের রাজনীতিকদের জন্য হতে পারে আদর্শ।একটু দূরেই সুউচ্চ পাহাড়, দূর থেকে দেখছি ছায়ার মতন। পাহাড় আমাদের টানছে, আর আমরা পাহাড়কে। কিন্তু মাঝখানে কাজের বিশাল চাপ, মূলত যে কারণেই এখানে আসা। এর ফলে আমাদের আর পাহাড়ের দূরত্বটা কমে আসছিলো না সহজেই। অবশেষে ২য় দিন আমরা দুপুরের আগেই সব কাজ সেরে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় ছুটলাম পাহাড়ের দিকে। আহ! কত সুন্দর দৃশ্য। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়, সবুজ আর সবুজ, পাহাড়ের উপর আদিবাসীদের খুপড়ি ঘর। সত্যি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। খুব সহজেই সবাই মিশে গেলো প্রকৃতির রাজ্যে। বড্ড রাগ হয় প্রতিবেশী দেশের উপর, এত সুন্দর পাহাড়ের কেবল অল্প অংশই আমাদের দেশে। পাহাড় জয়ের মজাই আলাদা, কিন্তু সেই মজায় নুন ছিটালো বেরসিক শৈলৎক্ষেপ বৃষ্টি। অবশেষে ভারি বর্ষণে ভিজেই ফেরা হলো ক্যাম্পে।পরদিন যাত্রা সাদা মাটির পাহাড়ে। ভ্রমণটা নৌকায় ছিলো বলেই অন্যরকম মজার। সোমেশ্বরীর দরিদ্র বুকে অল্প জলে ট্রলারে ভেসে ভাঙ্গা পাড় দেখতে দেখতে কেটে গেলো প্রায় দেড় ঘন্টার পথ। তারপর প্রায় ৩ কিলোমিটার হেঁটে বিজয়পুর। কি বিস্ময়! পাহাড় অথচ মাটিগুলো অন্যরকম। কোথাও সাদা, কোথাও বা লোহিত। সেখানে পাহাড়ে ওঠা, নমুনা সংগ্রহ, স্যারের ব্রীফ, স্যার ও বন্ধুদের সাথে ফটোসেশনের মধ্যে মজায় মজায় কেটে গেলো বেলা। অতঃপর বিদায় বিজয়পুর।সময়ের সাথে চলতে হয় আমাদেরও। অনেক অজানাকে জানা, অচেনাকে চিনতে চিনতে একসময় শেষ হয়ে আসে আমাদের ভ্রমণের সময় সীমা। আবার গাড়ীর চাকা ঘুরতে থাকে উল্টোপথে। তবুও রয়ে যায় পেছনের সময়গুলোর মুগ্ধতা। গাড়ির চাকা বেশ সজোরেই চলছিলো, তারপরও পেছন থেকে কে যেন গাইতে লাগলো- "গাড়ি চলেনা চলেনা, চলেনা রে, গাড়ি চলেনা"। আমরাও সুর মেলাতে থাকলাম।