শ্রীলঙ্কার সমস্যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, সমাজতাত্ত্বিকও বটে
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে একজন গবেষক। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় শ্রীলঙ্কা বিষয়ে একমাত্র গবেষণা গ্রন্থটি (‘শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম্’) তাঁরই লেখা। শ্রীলঙ্কায় চলমান সংকট নিয়ে এনটিভি অনলাইনের পক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ইয়াসির আরাফাত
শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকট কতটা রাজনৈতিক আর কতটা অর্থনৈতিক?
দেশে-বিদেশে প্রায় সবাই বলছে এটা ‘অর্থনৈতিক সংকট’। আমার এতে সামান্য ভিন্নমত আছে। শ্রীলঙ্কার এই সংকট অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও বেশি কিছু। এই সংকটকে কেবল অর্থনীতির প্রচলিত সূচকগুলো দিয়ে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। শুধুই অর্থনৈতিক কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এর সমাধানও পাওয়া যাবে না।
এটা সত্য, দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা—তথা ডলারের অভাবে পড়েছে। তারা আমদানি ব্যয় মেটাতে না পারার সমস্যায় পড়েছে। বিদেশি দেনার কিস্তি দিতে গিয়েও সমস্যায় পড়ছে। ফলে সেখানে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। অনেক ধরনের আমদানি পণ্য পাওয়াই যাচ্ছে না। কিন্তু দেশটিতে সবচাইতে দুষ্প্রাপ্য জিনিস আসলে সামাজিক পুঁজি।
নাগরিকদের মাঝে সিংহলি বৌদ্ধদের সঙ্গে হিন্দু তামিল ও মুসলমান তামিলদের সম্পর্ক অতি খারাপ শ্রীলঙ্কায়। এই তিন সম্প্রদায়ের মাঝে গভীর অবিশ্বাস বিদ্যমান। উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদ তামিলদের বিরুদ্ধে এত নির্মমতা দেখিয়েছে অতীতে এবং বিভেদের এত শক্ত প্রাচীর বানিয়েছে যে দেশটিতে জাতীয় ঐক্য বলে কিছু নেই।
একটা বিভক্ত জাতি যে টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখতে অক্ষম, শ্রীলঙ্কা একালে তার নজির। শ্রীলঙ্কার সংকট বুঝতে তাই আমাদের অর্থনীতির প্রচলিত তাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে এসে ভাবতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা দেশটির সংকটের গভীরতা পুরোপুরি বুঝতে পারব।
কিন্তু শ্রীলঙ্কা তো ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল?
সেই বিজয়ই দেশটির সর্বনাশের বড় উৎস। গৃহযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সেখানে একদিকে তামিলদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা কবর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে উত্থান ঘটে উগ্র এক সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের। ওই বিজয়ের পর থেকে সিংহলি নেতৃত্বের বড় এক অংশ—বিশেষ করে রাজাপক্ষেরা নিজেদের জবাবদিহিতামুক্ত ভাবতে শুরু করে। জনগণ তাদের সেভাবেই ভোট দেয়। লাগামহীন ওই নেতৃত্ব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যা-ইচ্ছা-তাই করে দেশকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে। সে কারণেই আমি বলব, দেশটির সিংহলি ভোটারদেরও আজকের এই অবস্থায় অনেকখানি দায় রয়েছে। কারণ, তাঁরা রাজাপক্ষেদের ওপর অবিশ্বাস্যরকম ভরসা করেছিলেন।
পরিবারতন্ত্রকে সমস্যা বলা হচ্ছে। আরও অনেক দেশেই পরিবারতন্ত্র আছে। সেসব দেশকে তো এমন সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে না?
হ্যাঁ, পরিবারতন্ত্র দক্ষিণ এশিয়ার পুরোনো ব্যাধি। রাজনীতিতে মেধা ও যোগ্যতার বদলে ক্রমাগত পারিবারিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হতে থাকলে তার চূড়ান্ত পরিণতি কী হতে পারে লঙ্কার আজকের অবস্থা তার ভালো নজির। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও যে পরিবারতন্ত্র সংকটের জন্ম দেয়নি, সেটা বলা যাবে না। বিষয়টি আমরা অন্যভাবে ভাবতে পারি। ভারতে আজ হিন্দুত্ববাদের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্ব দেখছে সেখানে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস মানবাধিকার লঙ্ঘনের রাজনীতি রুখতে পারছে না। উগ্র ধর্মবাদী রাজনীতি কোনোভাবেই রুখতে না পেরে কংগ্রেস প্রায় বিলীন হতে বসেছে সেখানে। কংগ্রেস কেন এভাবে ব্যর্থ হলো? কারণ, দলটি পরিবারতন্ত্র দ্বারা অবক্ষয়ের শিকার। গান্ধী পরিবার কোনোভাবেই নতুন ভারতকে নেতৃত্ব দিতে পারছে না।
পাকিস্তানে দেখুন, পিপলস পার্টি ও মুসলিম লিগ পরিবারতন্ত্রের হাতে পড়ে শাসনকালে কীভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। মানুষ সেখানে একজন ক্রিকেটারকে প্রধানমন্ত্রী করেছিল কেন? তারা নষ্ট পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্তি চেয়েছিল বলেই।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষেরাই কেবল নয়, আরও কয়েকটি পলিটিক্যাল ডাইনেস্টি আছে। সেখানে বন্দরনায়েকে এবং প্রেমাদাসাও দুটি পলিটিক্যাল ডাইনেস্টি রেখে গেছেন। ঠিক এই কারণেই আজকে দেশটিতে গণ-অভ্যুত্থানের মতো অবস্থা থাকলেও সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক দল নেই। জন আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের শূন্যতা রয়েছে সেখানে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ রকম রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে পরিবারতন্ত্র। কেবল নেপালে বামপন্থিরা দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিকভাবে পলিটিক্যাল ডাইনেস্টিগুলোর প্রভাব কিছুটা কমাতে পেরেছে।
বাংলাদেশ যাতে তেমন সংকটে না পড়ে, সেজন্য কী কী বিষয় খেয়াল রাখা উচিত বলে মনে করেন।
প্রথম করণীয় হলো অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে জবাবদিহিতা এবং জন-অংশগ্রহণ। রাষ্ট্রীয় সম্পদ কোথা থেকে আসবে এবং কোথায় কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যয় হবে, সেই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় সমাজের নানান স্তরে আলাপ-আলোচনা হওয়া জরুরি। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষেরা এমন সব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে যাতে আয়-ব্যয়ে কোনো ভারসাম্য ছিল না। আজকে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদেরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে বড় বড় প্রকল্প নিয়ে জনগণের মাঝে চমক তৈরি করতে চাইছেন। এসব প্রকল্পের পেছনে যে ব্যয় হচ্ছে তা কতটা সঠিকভাবে হচ্ছে এবং তাতে জনগণ কী মাত্রায় উপকৃত হবে, এসব বিষয়ে পুনর্ভাবনা দরকার আছে। আরেকটি বিষয় হলো জাতীয় বিভেদ কমিয়ে আনা। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে এটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে অনেকে। একটা বিভক্ত জাতি ক্রমে সামাজিক পুঁজিশূন্য হয়ে পড়ে। আর তখন সে টেকসই উন্নয়ন পথ গড়তে পারে না। আমাদের দেশে শ্রীলঙ্কার মতো জাতিগত বিভেদ কম। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গভীরভাবে বিভক্ত বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক আবহ দ্বারা এই বিভক্তির মিটমাট করা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত বাংলাদেশে এখন কৃষিখাত দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় বিনিয়োগে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। অর্থনীতির বহুমুখীকরণ এবং কৃষি উৎপাদনের বহুমুখীকরণ না করার কারণে কী কী সংকট হতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের পর বহু দেশ তা করুণভাবে টের পাচ্ছে। আমাদের উন্নয়ন কৌশলে বড় ধরনের মোড় পরিবর্তন দরকার এখনই। শ্রীলঙ্কা কেবল পর্যটনের ওপর নির্ভর করে কী সর্বনাশ করেছে, সেটা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি।
গত বছর দেশজুড়ে জৈব কৃষি পদ্ধতি বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কার সরকার। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে এই সিদ্ধান্ত কতটা দায়ী?
এটা সংকট তৈরি করেছে; কারণ, এ রকম সিদ্ধান্তের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। দেশটিতে পলিটিক্যাল ডাইনেস্টি যখন যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিরোধীদল বা জনসমাজের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ করা হয়নি। জৈব কৃষির সিদ্ধান্তটি ভালো। কিন্তু হঠাৎ এক দিন সারা দেশে তাৎক্ষণিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে তো মহাসমস্যা হবেই। এ রকম সিদ্ধান্তের জন্য যে প্রস্তুতি ও যে ধারাবাহিক কর্মসূচি থাকা দরকার ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি। ও রকম কর্মসূচির জন্য আগে থেকে যথেষ্ট স্টাডিও করেনি আগে তারা। প্রেসিডেন্ট, যিনি এক সময় ছিলেন প্রতিরক্ষা সচিব, যাঁর ব্যাপক কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও নেই—তিনি এই বিপর্যয় ঘটান। দেশটিতে গত ২-৩ বছর এভাবেই অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। তবুও কেন এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলো দেশটিকে?
শ্রীলঙ্কার শিক্ষাব্যবস্থার একটা সুনাম ছিল আগে। আমাদের দেশে অনেকে মনে করেন এখনও বোধহয় সেই সুনাম আছে। আসলে এখন আর সেখানে গুণগতভাবে শিক্ষার আগের সুনাম নেই। এর কারণও উগ্র জাতীয়তাবাদ। সিংহলিরা ইংরেজিকে সরিয়ে সিংহলি ভাষাকে শিক্ষায় বাধ্যতামূলক করার পর থেকে সেখানে শিক্ষা ক্ষেত্রেও অবক্ষয় ঘটতে থাকে। মূলত উচ্চশিক্ষিত তামিলদের চাকরির বাজারে কোণঠাসা করতে ‘কেবল সিংহলা’ নীতি চালু করেছিলেন বন্দরনায়েকে। এতে সিংহলিরা খুব খুশি হয়। কিন্তু ক্ষতি হয় দেশের। বর্তমান পরিস্থিতিই তো বলে দিচ্ছে সেখানে ট্যালেন্টের অভাব পড়েছে। মেধা বিকাশের বদলে ওরা জোর দিয়েছিল জাতিবাদ ও ধর্মের ওপর। আসলে সিংহলিরা তাদের গত ৩০-৪০ বছরের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা না করলে আজকের সংকট থেকে তারা বের হতে পারবে না। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের হাতে এমন কোনো জাদু নেই যে শ্রীলঙ্কার সমস্যার তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান করে দিতে পারে। দেশটির সমস্যা রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক।