ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স-কানাডার

গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বন্ধ ও মানবিক সহায়তা প্রবেশে আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে না নিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা। স্থানীয় সময় (১৯ মে) সোমবার তিন দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের যৌথ বিবৃতিতে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি গাজায় প্রাণঘাতী অভিযান আরও জোরদার করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যের প্রেসিডেন্ট কিয়ার স্টার্মার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মার্ক কার্নি তাদের যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সম্প্রসারণের তীব্র বিরোধিতা করছি। গাজায় মানবিক দুর্ভোগের মাত্রা অসহনীয়।’ তারা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণেরও নিন্দা জানিয়ে ‘লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞার’ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই তিন দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। তিনি বলছেন, দেশকে হামাসের জন্য ‘বিশাল পুরস্কার’ প্রস্তাব করেছে।
তিন দেশের নেতারা নেতানিয়াহুর পূর্বের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রায় তিন মাস সম্পূর্ণ অবরোধের পর তিনি অবরুদ্ধ গাজায় মাত্র কয়েকটি ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। তারা এটিকে ‘অপর্যাপ্ত’ উল্লেখ করে সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েলি সরকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
গতকাল সোমবার ইসরায়েল মাত্র কয়েকটি ট্রাককে গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েল ‘জঘন্য কার্যকলাপ’ চালিয়ে গেলে তারা ‘হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না’। তারা ইসরায়েলি সরকারের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচের মতো সদস্যদের ‘ঘৃণ্য ভাষা’ ব্যবহারের সমালোচনা করেছেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করার কথা বলা হয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলছেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।

যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হুসাম জুমলট আল জাজিরাকে বলেছেন, এই তিনটি দেশের ‘এক নম্বর’ করণীয় হলো ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য কিছু অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়, পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।’
জুমলট আরও বলেন, ‘দেশগুলোর উচিত যুদ্ধাপরাধীদের (ইসরায়েল) জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিত করা। দেশগুলোকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আমাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে হবে।’
জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজ প্রশ্ন তুলেছেন যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি কাদের লক্ষ্য করে দেওয়া হয়েছে। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘কাকে লক্ষ্য করে? আপনাকে রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। এটা প্রধানমন্ত্রীর বিষয় নয়। এটা পুরো সরকারি উদ্যোগ।’
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল বারো আজ মঙ্গলবার বলেছেন, গতকাল ইসরায়েলের আংশিকভাবে অবরোধ তুলে নেওয়া ‘পুরোপুরি অপর্যাপ্ত’। তিনি ফ্রান্স ইন্টার রেডিওকে বলেন, নির্বিচার সহিংসতা এবং ইসরায়েলি সরকার কর্তৃক মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া’ অবরুদ্ধ অঞ্চলটিকে ‘মৃত্যুর ফাঁদে’ পরিণত করেছে।
আল জাজিরার হামদাহ সালহুত জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে জানান, আন্তর্জাতিক চাপ নেতানিয়াহুর ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নেতানিয়াহু এর আগে ‘পরম বিজয়’ না আসা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার দেশ এটিকে ‘বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছে। তিনি বলেন, ‘ ইসরায়েল বলছে, সামরিক স্থল অভিযানের সম্প্রসারণই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।’
এর আগে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডাসহ ২৩টি দেশ একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে ইসরায়েলকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
সোমবার প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মানবিক সহায়তা কখনোই রাজনীতিকরণ করা উচিত নয়। এটি সুবিধাভোগী ও ত্রাণকর্মীদের ঝুঁকিতে ফেলে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের ভূমিকা, স্বাধীনতা ও আমাদের বিশ্বস্ত অংশীদারদের দুর্বল করে তোলে।
নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম থেকে আল জাজিরার স্টেপ ভেসেন জানান, আজ মঙ্গলবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্লকের বাণিজ্য চুক্তি পর্যালোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘গাজায় দেড় বছর ধরে চলমান বোমা হামলা ও খাদ্য অবরোধের ফলে জনরোষ তৈরি হওয়ার পর আমরা একটি পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।’
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ‘গণহত্যার মধ্যে প্রায় ৮০ দিন ধরে চলমান অনাহার ও নিষ্ঠুরতা’ সত্ত্বেও ইসরায়েলের অবরোধ তুলে নিতে বিশ্বের চাপ প্রয়োগে এতটা সময় লাগা ‘আশ্চর্যজনক ও নৈতিকভাবে নিন্দনীয়’।
তবে বিশ্ব শক্তিগুলো যখন নির্বিচারে হামলা ও মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়ে সরব হয়েছে তখন গাজাজুড়ে প্রাণঘাতী হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। সোমবার মধ্যরাত থেকে ৭৩ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে ড্রোন হামলায় অন্তত তিন শিশু নিহত হয়েছে।