ভারতের ৮০ লাখ পুরুষের বন্ধ্যত্বের আড়ালে এক বিভীষিকাময় অধ্যায়

১৯৭৬ সালের নভেম্বরের এক শীতের রাতে উত্তর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াত অঞ্চলের উত্তরাখণ্ড গ্রামকে পুলিশ ঘিরে ফেলে। তাদের নির্দেশ ছিল, গ্রামের ঊর্বর বয়সের সব পুরুষকে এক জায়গায় জড়ো হতে হবে। সেই রাতে অন্যদের মতো পালাতে পারেননি মোহাম্মদ দীনু।
তখন ভারত ১৭ মাস ধরে একনায়কতন্ত্রের মুখোমুখি ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ জারি করেছিলেন, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার রাজনৈতিক বিরোধীকে বিনা বিচারে জেলে ঢোকানো হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমকে সেন্সর করা হয়েছিল। আর বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তায় ভারত এক বিশাল ‘জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ’ কর্মসূচি শুরু করে।
মোহাম্মদ দীনু ও তার ১৪ জন বন্ধুকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে বন্ধ্যাকরণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। দীনু এটিকে গ্রামের জন্য ‘ত্যাগ’ হিসেবে দেখেন, যা তার গ্রামের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করেছিল। নব্বই পেরোনো দীনু বলেন, ‘যখন সবাই নিজেদের বাঁচাতে পালাচ্ছিল, তখন গ্রামের কিছু বয়স্ক মানুষ বুঝেছিলেন, যদি কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তাই গ্রামের কিছু পুরুষকে একত্রিত করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।’ তিনি গর্ব করে বলেন, ‘আমরা আমাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই গ্রামকে বাঁচিয়েছি। গ্রামটি আজ ঈশ্বরের সন্তানদের দ্বারা পূর্ণ।’
জরুরি অবস্থার ৫০ বছর : এক ভয়াবহ স্মৃতি
আজ ২৫ জুন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারত জরুরি অবস্থা জারির ৫০ বছর পূর্ণ করছে। মোহাম্মদ দীনু উত্তরাখণ্ড গ্রামের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যাকে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণে বাধ্য করা হয়েছিল।
১৯৭৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত চলা এই জরুরি অবস্থায় প্রায় ৮০ লাখেরও বেশি পুরুষকে ভ্যাসেকটমি (পুরুষ বন্ধ্যাকরণ) করতে বাধ্য করা হয়েছিল। শুধু ১৯৭৬ সালেই প্রায় ৬০ লাখ পুরুষকে বন্ধ্যা করা হয়। ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে প্রায় দুই হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। পাঁচ দশক পরও উত্তরাখণ্ড গ্রামে সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে।
‘এক কবরস্থান, কেবল নীরবতা’
স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালে ভারত বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ‘জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য ছিল পরিবারগুলোকে দুটি সন্তানের বেশি না নিতে উৎসাহিত করা।
১৯৬০-এর দশকে যখন প্রতিটি মহিলার গড় ৬টি সন্তান ছিল, তখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়। ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যাকে অর্থনীতির ওপর বোঝা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। পশ্চিমা বিশ্বও এই ধারণার সঙ্গে একমত ছিল : বিশ্বব্যাংক ভারতকে বন্ধ্যাকরণ উদ্যোগের জন্য ৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল না হলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুধার্ত ভারতকে খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দিত।
কিন্তু জরুরি অবস্থার সময় যখন সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থগিত ছিল, ইন্দিরা গান্ধী সরকার জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ কার্যকর করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সম্প্রদায়গুলোকে বাধ্য করতে শক্তি ও শাস্তির আশ্রয় নেয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বন্ধ্যাকরণের লক্ষ্যমাত্রা (কোটা) নির্ধারণ করা হয়েছিল। যারা লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হতো তাদের বেতন আটকে দেওয়া হতো বা চাকরি হারানোর হুমকি দেওয়া হতো। অন্যদিকে, যেসব গ্রাম সহযোগিতা করতে রাজি হতো না, তাদের সেচের জল বন্ধ করে দেওয়া হতো।
যারা প্রতিরোধ করত, তাদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী নামিয়ে আনা হতো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরাখণ্ড গ্রামও ছিল এমন লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে একটি। সেই সময় ভারতে মুসলিমদের জন্মহার অন্য সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশি ছিল, যা মুসলিমদেরকে গণ বন্ধ্যাকরণের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল।
দীনুর বাড়ির পাশের গলিতে ১৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ নূর তার বাবার কোলে খাটে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। তার বাবা পাশের জঙ্গলে দৌড়ে পালিয়ে যান, আর নূর ছুটে ঘরের ভেতরে লুকিয়ে পড়ে। নূর স্মরণ করে, ‘তারা দরজা ও তাদের পথে আসা সবকিছু ভেঙে ফেলে, যা কিছু দেখতে পেত, ভেঙে দিত।’ ‘আমাদের জীবন আরও খারাপ করার জন্য তারা ময়দার সঙ্গে বালি মিশিয়ে দেয়। গ্রামে এমন একটিও বাড়ি ছিল না, যেখানে পরের চার দিনের জন্য খাবার রান্না করা যেত।’
ওই অভিযানে নূরকেও ধরা হয়, স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে মারধর করা হয়। সে জানায়, তার বয়স ১৫ বছরের কম হওয়ায় তাকে বন্ধ্যাকরণের জন্য খুব ছোট মনে করা হয়েছিল।
সেই ভয়ঙ্কর রাত যা এখন গ্রামটির লোককাহিনীর অংশ। গ্রামপ্রধান আব্দুল রেহমানের কথা এখনও মনে করিয়ে দেয়। নূরের ছোটবেলার বন্ধু তাজামুল মোহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাইরে কেউ এই নাম মনে রাখবে না, কিন্তু আমরা রাখি।’ তাজামুল ও নূর দুজনেরই এখন ৬৩ বছর বয়স।
পরের বছরগুলোতে এর প্রভাব আরও স্পষ্ট ও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো উত্তরাখণ্ডের পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হতো না, এমনকি যারা বন্ধ্যা হয়নি তাদের সাথেও। অনেকে তাদের বিদ্যমান বাগদানও ভেঙে দিত।
স্থানীয় সমাজকর্মী কাসিম বলেন, ‘কিছু লোক (উত্তরাখণ্ডের পুরুষরা) সেই মানসিক ধাক্কা থেকে কখনও সেরে উঠতে পারেনি। তাদের জীবনের বছরের পর বছর উদ্বিগ্ন বা অস্থিরভাবে কাটিয়েছিল।’ ‘উত্তেজনা ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা তাদের হত্যা করেছিল এবং তাদের জীবন ছোট করে দিয়েছিল।’

আজকের ভারতে এর প্রতিধ্বনি
আজ ভারতে আর কোনো জোরপূর্বক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেই। দেশের প্রজনন হার এখন প্রতি মহিলার মাত্র দুটি সন্তানের বেশি নয়। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে জরুরি অবস্থার সময় যে ভয় ও ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা এখন নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
প্রখ্যাত ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন মনে করেন, জরুরি অবস্থা কর্তৃত্ববাদকে স্থায়ী করতে সাহায্য করেছিল। ক্রমবর্ধমান ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭১ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। রায়ে তাকে ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এর তেরো দিন পর গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
বিশ্বনাথন আল জাজিরাকে বলেন, ‘স্বৈরাচারবাদের অবহেলা জরুরি অবস্থা তৈরি করেছিল, যার কোনো অনুশোচনা ছিল না।’ ‘আসলে জরুরি অবস্থা আজকের ভারতে পরবর্তী জরুরি অবস্থা তৈরি করেছে। এটি ছিল উত্তর-আধুনিক ভারতের ভিত্তি।’
বিশ্বনাথন বিশ্বাস করেন, ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হলেও ভারত সম্পূর্ণ কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ‘ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত তাদের প্রত্যেকেই গণতন্ত্রের ভান করে একটি কর্তৃত্ববাদী সমাজ তৈরিতে অবদান রেখেছেন।’
সাত প্রজন্ম!
১৯৭৬ সালের নভেম্বরে দীনু বলেছিলেন, যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনি কেবল তার গর্ভবতী স্ত্রী সালিমার কথাই ভাবছিলেন, যিনি তখন বাড়িতে ছিলেন। ‘অনেক পুরুষ, অবিবাহিত বা নিঃসন্তান পুলিশদের কাছে তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন’। দীনুর ১৪ জন বন্ধুর কাউকেই ছাড়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘নসবন্দী এক এইসা শ্রাপ হ্যায় জিসনে উত্তরাওয়ার কো তবে হর রাত পরেশান কিয়া হ্যায়।’ (বন্ধ্যাকরণ একটি অভিশাপ যা তখন থেকে প্রতি রাতে উত্তরাওয়ারকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।)
আট দিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পর দীনুকে উত্তরার নিকটতম শহর পালওয়ালের একটি বন্ধ্যাকরণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যেখানে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। এক মাস পর ভ্যাসেকটমি থেকে ফিরে আসার পর সালিমা তাদের একমাত্র সন্তান একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।
আজ দীনুর তিন নাতি ও বেশ কয়েকজন প্রপৌত্র-প্রপৌত্রী রয়েছে। ‘আমরাই এই গ্রামকে বাঁচিয়েছি’, তিনি হেসে বললেন। ‘নইলে ইন্দিরা এই গ্রামকে আগুনে পুড়িয়ে দিতেন।’
২০২৪ সালে দীর্ঘ অসুস্থতার পর সালিমা মারা যান। এদিকে দীনু তার দীর্ঘায়ুতে আনন্দিত। তিনি একসময় তার দাদুর সঙ্গে খেলতেন, এখন তার প্রপৌত্রীদের সঙ্গে খেলেন। ‘সাত প্রজন্ম!’ তিনি তার প্লাস্টিকের কাপে একটি ঠান্ডা পানীয় থেকে চুমুক দিতে দিতে বললেন। ‘তুমি কতজনকে এই সুযোগ উপভোগ করতে দেখেছো?’