চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

রাজনীতি দ্রুত বদলায়। পাঁচ বছর আগে গালওয়ানে ভারত ও চীনের সেনার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। এর জেরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়। তারপর সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হলেও পুরো স্বাভাবিক হয়নি। গালওয়ানের পাঁচ বছর পর যখন শুল্ক নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দূরত্ব বেড়েছে, তখন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারত সফরে এলেন।
এই মাসের শেষে প্রধানমন্ত্রী মোদি সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) বৈঠকে যোগ দিতে চীন সফর করবেন। ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর এসসিও বৈঠক হবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র ভারত সফরে সেই বিষয়টি নিয়েও কথা হয়েছে। তবে শুধু এ কারণেই নয়, তার ভারত সফর অনেকগুলো কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়াং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অজিত দোভালের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে দেখা করবেন।
দিল্লিতে এসে ওয়াং ই বলেছেন, ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত বোঝাপড়া দরকার। তাদের একে অপরকে অংশীদার হিসেবে ভাবতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। চীন ভারতের প্রতি সৌহার্দ্যের নীতি নিয়ে চলতে তৈরি। এর ফলে পারস্পরিক লাভ হবে।
আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জয়শংকর বলেন, আমরা আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কঠিন সময় দেখেছি। দুই দেশ সেখান থেকে আগে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে দুই দেশেরই গঠনমূলক নীতি নিয়ে চলতে হবে। এই পরিস্থিতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা ও পারস্পরিক সংবেদনশীলতার নীতি নিতে হবে। মতভেদ যেন বিরোধে পরিণত না হয়। প্রতিযোগিতা যেন সংঘাতে বদলে না যায়।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতকে জানিয়েছেন, তারা ভারতে আবার সার, রেয়ার আর্থ এবং সুড়ঙ্গ খনন করার যন্ত্র টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) রপ্তানি শুরু করবেন। সূত্র উদ্ধৃত করে ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, এই তিনটি জিনিস পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। চীন রেয়ার আর্থ সরবরাহ বন্ধ করায় গাড়ি ও ইলেকট্রনিক শিল্পের ওপর তার প্রভাব পড়েছিল।
ওয়াংয়ের সফরের গুরুত্ব
ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, বিশ্বের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে কোনো দেশই অপর এক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করতে পারে না, বা পুরোপুরি নির্ভর করে থাকতে পারে না। আমেরিকার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। চীনের সঙ্গেও তাই।
তিনি জানিয়েছেন, চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধের কোর ইস্যু বা মূল বিষয়ের ফয়সালা এখনো হয়নি। সেটাকে আমরা বিচ্ছিন্ন করেও এগোচ্ছি এমন নয়। কূটনীতির ক্ষেত্রে আমরা চীনকে ভেবে পদক্ষেপ নিই। আমাদের সবদিক সামলেই চলতে হবে। চীন ও আমেরিকাকে নিয়েই চলতে হবে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং দ্য টেলিগ্রাফ ও আউটলুক পত্রিকার কূটনীতি বিষয়ক সাবেক সম্পাদক প্রণয় শর্মা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ২০২০ সালে সংঘাতের পর চীনের সঙ্গে ভারতের অনেকগুলো বৈঠক হয়েছে। সীমান্তের অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে সেনা পেছনে সরেছে। সেই প্রক্রিয়া চলছে। মোদি যে এসসিওতে যাবেন তা আগেই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে গেছে।
প্রণয় শর্মা জানিয়েছেন, ট্রাম্প যখন আবার প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন মোদির উপদেষ্টারা মনে করেছিলেন, শুরুতেই দুই নেতার মিটিং হলে সম্পর্ক ভালো হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক মানে ভারতের কোনো পণ্য মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকবে না।
তিনি বলেছেন, ট্রাম্প বিভিন্নভাবে ভারতকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে দুইবার ডাকা হলো। ভারতের স্পর্শকাতরতার তোয়াক্কা করা হলো না। এই অবস্থায় ভারতও রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক চাঙ্গা করতে চাইছে। ভারত কখনই আমেরিকাকে রাতারাতি ছেড়ে দেবে না। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার তাগিদ বাড়বে।
চীন এরকমই করে
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, চীন বর্তমান সমস্যাকে আলমারিতে রেখে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলে। তারা তাড়াহুড়ো করে না। তারা তাদের বাণিজ্যকে খুবই বেশি গুরুত্ব দেয়। সমস্যা নিয়েও কথা চলতে থাকে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অনেকদিন ধরে ওই পদে রয়েছেন। তিনি যখন দরকার হচ্ছে, তখন সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছেন। আমেরিকা ও ভারতের সঙ্গে সেটাই হয়েছে। আগে রাশিয়ার সঙ্গেও করেছে।
উৎপল ভট্টাচার্য মনে করেন, একটা কথা মনে রাখা দরকার আমরা চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে পারি না। পাকিস্তানসহ কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের গুরুতর সমস্যা আছে। চীনের সঙ্গে যে সমস্যা আছে, তার অবিলম্বে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না, কিন্তু তাদের সঙ্গে সামগ্রিক সম্পর্ক ভালো করার ক্ষেত্রেও তো কোনো বাধা নেই।
সীমান্ত সমস্যা নিয়েও কথা
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে জয়শংকর ও অজিত ডোভালের বৈঠক হয়েছে। সেখানে ভারত-চীন সম্পর্ক নিয়ে যেমন কথা হয়েছে, তেমনই সীমান্ত সমস্যা নিয়েও কথা হয়েছে বলে প্রণয় জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার পথটা খুলে রাখতে চায়।
শ্রীরাধাও মনে করেন, আমেরিকা ভারতকে যা বোঝাবার তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তাদের কাছে ভারতের প্রয়োজন এখন সীমিত। ফলে ভারতকেও বিকল্পের সন্ধান করতে হবে।
প্রণয় বলেছেন, ভারতের সঙ্গে পরে ট্রাম্পের সম্পর্ক ভালো হয়ে গেলেও তারপর কী হবে তা কেউ জানে না। ট্রাম্প যে আবার ভারতের সঙ্গে এরকম আচরণ করবেন না, তা কে বলতে পারে? তাই এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে যাতে আর এরকম অবস্থায় না পড়ি, তা দেখতে হবে।
উৎপল ভট্টাচার্য মনে করেন, আমাদের সবকিছু পাকিস্তান-কেন্দ্রিক যেন না হয়। পাকিস্তানের ভূখণ্ড, জনসংখ্যা আমাদের সাত ভাগের এক ভাগ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হলে চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে। সেটা মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। ভারত কোয়াডে আছে বলে চীন খুশি নয়। আবার ভারত ব্রিকসে আছে বলে আমেরিকা খুশি নয়। কিন্তু ভারত নিজের স্বার্থে কাজ করবে, অন্যকে খুশি করার জন্য নয়। সেই লক্ষ্যেই তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।