চীন-রাশিয়ার সঙ্গে থেকে ট্রাম্পের চাপ সামলাতে পারবেন মোদি?

ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধের মোকাবিলায় ভারত এখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে। এভাবে কি সমস্যার সমাধান হবে?
অল্প সময়ের ব্যবধানে রাশিয়া সফর করলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর এবং জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গত সপ্তাহেই ভারতে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুইদিনের জাপান সফর সেরে ৩১ অগাস্ট চীনে যাচ্ছেন এসসিও বৈঠকে যোগ দিতে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ২০টি দেশের রাষ্ট্রনেতারা এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। দিল্লিতে রাশিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহেই আশাপ্রকাশ করেছিলেন, রাশিয়া, চীন ও ভারতের শীর্ষনেতাদের বৈঠকও শীঘ্রই হবে। সেটা যদি এসসিও সম্মেলনের পাশাপাশি হয়, তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-পরবর্তী সময়ে ওই শীর্ষ বৈঠক কূটনীতির ক্ষেত্রে খুব বড় ঘটনা বলে চিহ্নিত হতে পারে।
ঘটনা হলো, মার্কিন শুল্ক-হুমকি সত্ত্বেও ভারত দুটো বিষয় খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া থেকে তারা তেল কিনবে এবং ভারতের কৃষক, পশুপালক, ডেয়ারি শিল্প ও ছোট ও মাঝারি শিল্পের সর্বনাশ করে মার্কিন শর্ত মেনে বাণিজ্য চুক্তি করা হবে না। এই অবস্থায় ট্রাম্পের শুল্ক-ধাক্কার মোকাবিলায় ভারত ক্রমশ রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। বুধবার নতুন হারে মার্কিন শুল্ক চালু হচ্ছে। তার আগে ভারতের এই কূটনীতি নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
অন্য দেশের দিকে তাকাতে হয়
ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার, পাকিস্তানের সাবেক কনসাল জেনারেল, সার্ক সামিট সেক্রেটারিয়েটের সাবেক ডিরেক্টর পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, যখন এই ধরনের একটা টার্বুলেন্স হয়, তখন অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে হয়। একটা দেশ যখন আমাদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেয়, তখন আমরাও জাতীয় স্বার্থে পরিস্থিতির মূল্যায়ণ করি।
তবে পিনাক রঞ্জন জানিয়েছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কাজটা আগে থেকেই হচ্ছিল। ট্রাম্প শুল্ক বসানোর আগে থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিন ধরে খুব ভালো সম্পর্ক। আমরা রাশিয়া থেকে তেল কিনছি সেটা আমেরিকার পছন্দ হচ্ছে না। ওরা বলছে, ওই টাকায় সন্ত্রাস হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া থেকে ইইউ গ্যাস কিনছে, অনেক বেশি টাকার কিনছে, সেক্ষেত্রে? আমেরিকা নিজে রাশিয়া থেকে জিনিস কিনছে। ট্রাম্প আমি কিছু জানি না বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
তাহলে তিনি ভারতের ওপর এই ধরনের শুল্ক-চাপ তৈরি করছেন কেন? পিনাক রঞ্জন মনে করেন, ট্রাম্পকে কেউ হয়তো বুঝিয়েছে, ভারতের ওপর চাপ দিলে যুদ্ধ বন্ধ হবে। কেউ হয়তো বুঝিয়েছে, এরকমভাবে চাপ দিলে ভারত ভয় পেয়ে বাণিজ্য চুক্তি করে ফেলবে। মার্কিন সংস্থাগুলোকে প্রচুর ছাড় দেবে। ওনার ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডা হলো বাণিজ্য চুক্তি। সেজন্যই পাকিস্তানের সঙ্গে দহরম মহরম করছেন ট্রাম্প।
তার মতে, ট্রাম্প ভারতের ওপর চটে গেছেন, কারণ আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে তার ভূমিকার দাবি মানিনি। পাকিস্তান তাকে মাথায় তুলে দিয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কারের কথা বলে। আমরা সেসব করিনি।
সীমাবদ্ধতা আছে
ভারত ও চীন কাছাকাছি আসতে চাইছে ঠিকই, তবে তার মধ্যে একটা সীমাবদ্ধতাও আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ওপি জিন্দল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা আছে। চীনের সঙ্গেতো ইতিহাসগত সমস্যা আছে। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা প্রবলভাবে রয়েছে। এটাও ঠিক, তারা ভারতকে ব্যবহার করতে চায়।
শ্রীরাধা মনে করেন, এখন ইস্যুভিত্তিক সম্পর্কের দিকে যেতে হবে। আগে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ছিল, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, তাদের সব ভালো। কিন্তু এখন আর সেরকম সর্বাত্মক সম্পর্কের দিন চলে গেছে। তাই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, তবে তা হবে ইস্যুভিত্তিক।
শ্রীরাধার মতে, আমাদের মনে রাখতে হবে, চীন আমাদের শুভাকাঙ্খী হবে না। ওরা স্বার্থ থাকলে আসবে, না থাকলে নয়। তবে আমাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কথা বন্ধ করে দিলে আলোচনার জায়গাও বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছে। ফলে সম্পর্কও থাকবে।
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা জানিয়েছেন, এই সমস্যার মূলে যেতে গেলে আমাদের ২০১৪-১৫তে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি তখন কখনো চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দোলনায় দুলছেন, কখনো হাউডি মোদি, নমস্তে ট্রাম্প করছেন। বলছেন, ট্রাম্প তার বন্ধু। তিনি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছেন। তারপর দুই নৌকা থেকেই উল্টে পড়ে গিয়েছেন। এই বিষয়টা আমাদের মাথায় রাখা দরকার।
দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাবেক সিনিয়র এডিটর, নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাবেক বিজনেস এডিটর, পিটিআইয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান জয়ন্ত রায়চৌধুরীও এই বিষয়ে শ্রীরাধার সঙ্গে একমত। তিনি বলেছেন, চীনের থেকে ভারতের অনেক কিছু নেওয়ার আছে। কিন্তু তারা চীনের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না। তাদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত সমস্যা আছে, তাছাড়া এশিয়াতে চীন হলো ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তিব্বতের প্রশ্নেও ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধ আছে।
জয়ন্ত মনে করেন, গত ৩০ বছরে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ভারত ও আমেরিকা কাছাকাছি এসেছে। ভারত আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক পরমাণু চুক্তি করেছে। প্রচুর প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। আমেরিকার প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে ভারত একসঙ্গে কাজ করছে। ভারত কোয়াডের সদস্য। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। ভোটদাতার নিরিখে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলো ভারতের স্বাভাবিক মিত্র দেশ।
জয়ন্ত বলছেন, ভারতের ওপর আমেরিকার ৫০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কায় বস্ত্র, হীরে, সোনা ও অলংকার শিল্প, চামড়া, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ধাক্কা খাবে। ট্রাম্প এখনো ওষুধের ওপর শুল্ক বসাননি। ফলে শুল্ক-ধাক্কাতো আছেই।
সাময়িক সমস্যা
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের এই সমস্যা সাময়িক। ট্রাম্প আর কতদিন ওই পদে থাকবেন, তিন, সাড়ে তিন বছর। আমরা এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা আগেও করেছি। নিউক্লিয়ার প্রলিফারেশন ট্রিটি (এনপিটি) সই করা নিয়ে কী প্রবল চাপ ছিল। আমরা তার থেকে বেরিয়ে এসেছি।
চাকরিজীবনে এই ধরনের অনেক চাপের মোকাবিলা করা পিনাক রঞ্জনের মতে, এই কারণেই তো আমেরিকা আমাদের ওপর চটেছে। আমরা রুখে দাঁড়াই। জাপান, ইইউ কেউ রুখে দাঁড়ায়নি। অথচ ভারত দাঁড়িয়েছে। তাই ওদের প্রশ্ন, ভারত কেন ওদের কথা মানবে না?
শ্রীরাধাও মনে করেন, এটা ট্রাম্পের পার্সোনালিটি প্রবলেম। কংগ্রেস বা অন্য কমিটি এই বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলে ট্রাম্প এটা করতে পারছেন। তবে তা বেশিদিন টিকবে না। টেকা সম্ভব নয়।