আবারও গভীর রাজনৈতিক সংকটের মুখে ফ্রান্স

ফ্রান্স আবারও গভীর রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি দেখে প্রখ্যাত ফরাসি নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গল এর বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যায়, ‘২৪৬ ধরনের পনিরের দেশকে কেউ কীভাবে শাসন করতে পারে?’ ৬০ বছরেরও বেশি সময় পরে মনে হচ্ছে, এর উত্তর সম্ভবত ‘কেউই নয়’।
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফ্রাঁসোয়া বেয়রু পদত্যাগ করতে চলেছেন বলে মনে হচ্ছে। তার ভাগ্য এখন পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের ওপর নির্ভর করছে। যদি তিনি হেরে যান, তাহলে এটি পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে একটি নতুন রেকর্ড হবে ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে আগের চেয়েও দুর্বল করে দেবে।
বর্তমান সংকটের মূল কারণ
বেয়রু ৪৪ বিলিয়ন ইউরোর একটি কঠোর সঞ্চয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ভোট আহ্বান করেছেন, যার মধ্যে দুটি সরকারি ছুটি বাতিল ও ব্যয় স্থগিত করার প্রস্তাব রয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘২০ বছর ধরে প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা ও প্রতি রাতে ঋণ ১২ মিলিয়ন ইউরো করে অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।’ এই বাজেট সংস্কারটি তার পূর্বসূরী মিশেল বার্নিয়ারের পতনের কারণ হয়েছিল। বার্নিয়ের মাত্র তিন মাস প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতার এই গভীর সময়ে ফ্রান্সের ঋণের খরচও বেড়েই চলেছে। দেশটির দশ বছরের বন্ডের বোঝা জমে এখন স্পেন, পর্তুগাল ও গ্রিসের মতো ইউরোজোনের ঋণ সংকটে থাকা দেশগুলোর চেয়েও বেশি, যা ইতালির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
ম্যাক্রোঁর ভুল সিদ্ধান্ত
বর্তমান অস্থিরতার মূল কারণ ম্যাক্রোঁর একটি নাটকীয় সিদ্ধান্ত। ২০২৪ সালের মে মাসে ইউরোপীয় নির্বাচনে অতি-ডানপন্থি দলের অসাধারণ ফলাফলের পর ম্যাক্রোঁ আগাম নির্বাচন ডেকেছিলেন। সেই নির্বাচনে তার নিজের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় ও সংসদ বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে ফ্রান্সের রাজনীতিতে এক নতুন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
এরপর থেকে ম্যাক্রোঁ বারবার সংবিধানের ৪৯.৩ ধারা প্রয়োগ করতে বাধ্য হন, যার মাধ্যমে তিনি কোনো ভোট ছাড়াই আইন পাস করতে পারেন। এই পদক্ষেপ বিরোধী আইন প্রণেতা ও ফরাসি জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। ফ্রান্সে জার্মানি বা ইতালির মতো জোট গঠনের কোনো ঐতিহ্য নেই, যা রাজনৈতিক সমাধানকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
ভবিষ্যৎ কী হবে?
যদি বেয়রুর পতন হয়, তাহলে ম্যাক্রোঁর ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়বে। তবে তিনি তার মেয়াদ পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতি-ডানপন্থি নেতা মেরি লি পেন সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দাবি করছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, নতুন নির্বাচন হলে অতি-ডানপন্থি দল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে ও রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে।
তিনজন ব্যর্থ মধ্যপন্থি প্রধানমন্ত্রীর পর বিরোধী দলগুলো আর একজন মধ্যপন্থি নেতাকে সুযোগ দিতে রাজি নয়। অতি-ডানপন্থি ও অতি-বামপন্থি উভয়ই ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা অবিলম্বে অনাস্থা ভোটের আহ্বান জানাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্রান্স এখন এমন একটি রূপান্তরের পর্যায়ে রয়েছে যেখানে একটি পুরোনো ব্যবস্থা আর কাজ করছে না, কিন্তু নতুন কোনো ব্যবস্থারও কোনো রূপরেখা নেই।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও জন-অসন্তোষ
ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক সংকট এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। প্যারিসের এই অস্থিরতা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক দিক, কারণ তারা ইউরোপের দুর্বলতাকে উপহাস করতে আনন্দ পায়।

১০ সেপ্টেম্বর ব্লকোনস টাউট (সবকিছু ব্লক করো) ব্যানারে দেশব্যাপী বিক্ষোভের মাধ্যমে ফরাসি জনগণের ক্ষোভ রাস্তায় নেমে আসার জন্য তৈরি হচ্ছে। প্যারিস-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট মন্টাইনের একজন জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ডোমিনিক মোইসি বলেন, তিনি পঞ্চম প্রজাতন্ত্রে এত গভীর অচলাবস্থার মুহূর্ত এর আগে দেখেননি।
ডি গল তার পনিরের উক্তি সত্ত্বেও পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের মাধ্যমে ফ্রান্সে আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা এনেছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, ম্যাক্রোঁ কি সেই রাষ্ট্রপতি হবেন, যার হাতেই এই স্থিতিশীলতার শেষ হলো?