স্মরণ
শামসুর রাহমান : খণ্ড স্মৃতির দীর্ঘ ছায়ায়

ছোটবেলা থেকে কবিতার অক্ষরে দেখে এসেছি শামসুর রাহমানকে আর প্রথম প্রত্যক্ষ দেখা যতদূর মনে পড়ে তাঁর পঁচাত্তর জয়ন্তীতে চারুকলার বকুলতলায় আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা সভায়। সর্বস্তরের মানুষের কী বিপুল অভ্যর্থনায় অভিষিক্ত হচ্ছিলেন কবি; তা দেখছিলাম আর তার চেয়ে বেশি দেখেছি অভ্যর্থনার মঞ্চে সুবচন আর পুষ্পের উত্তরে কতটা বিনীত, কতটা কোমল তিনি। ভাবছিলাম, কোমল এই কবিপ্রাণ কতটা দার্ঢ্যে অবরুদ্ধ সময়ে উচ্চারণ করেন স্বাধীনতার কথা কিংবা ভ্রাতৃহত্যায় ক্রুদ্ধ কবি কতটা সোচ্চারে শূন্যের মুখে ছুড়ে দেন এই সোচ্চার প্রশ্ন :
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়,
তেমন যোগ্য সমাধি কই!
চকিতে স্মৃতিতে ভেসে আসে ২০০১-এর সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী আমার মফস্বল শহরের ছবি। সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিদারুণ দিনগুলোতে এই শামসুর রাহমানের কবিতা ধার করেই তো আমরা প্রতিবাদীপক্ষ রচনা করেছি সুধাংশু যাবে না শিরোনামে—
এই পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।
সেই শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার মুখোমুখি বসে কথা সম্ভবত ২০০৪-০৫ সালের দিকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র আমরা, তাঁর কাছে একটি লিটলম্যাগের জন্য লেখা চাইতে যাওয়া। এর আগে জাবির বাংলা বিভাগ আয়োজিত বসন্ত উৎসবের ঘরোয়া আয়োজনে বক্তব্য রেখে গেছেন তিনি। কিছুটা অসুস্থ দেখেছি তখনই। আর এর সকালে যখন গেলাম ‘শ্যামলীর গালিব'-এর গৃহে, তখন তিনি আরো অসুস্থ। নতুন লেখার অবস্থায় ছিলেন না মোটেও; কিন্তু অজানা-অচেনা তরুণের অভ্যর্থনায় তাঁর যে ব্যাকুলতা দেখেছি তাতে আপ্লুত হয়ে ভেবেছি, এ তো ঐতিহ্যেরই সুরভিত উত্তরাধিকার। বুদ্ধদেব বসু-আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতো অগ্রজদের অভ্যর্থনা পেয়ে যাঁর জীবন পলিময় হয়েছে, অনুজদের জন্য তিনিই তো হতে পারেন এতটা সহজ-সুন্দর। না, অসুস্থ কবির লেখা আমরা পাইনি, তবে প্রথম দিনই পেয়ে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অলিখিত-অবাধ অধিকারপত্র। এরপর তাঁর চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েক সকাল শ্যামলীর নিঝুম বাড়িটিতে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি এখানে টুকে রাখছি।
একদিনের কথা। সামনে বোধ হয় বইমেলা। প্রকাশক তাঁর কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়ে গেছেন। কিন্তু কবি কিছুতেই নাম স্থির করতে পারছেন না। একটি প্রস্তাবিত নাম জালিমের কণ্টকিত জালে, আর একটি গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন নামটি দিলে ভালো হয়। আমি বললাম, ‘অবশ্যই দ্বিতীয়টি।’ তাঁর ঘরে আরো কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন সেদিন; অনেকেই তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তাপ বিবেচনায় প্রথম নামটি সমর্থন করলেন। কবি আমার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বললাম—কবিতা তো চিরায়ত বিষয়; কবিতার বইয়ের নামও তাই। দ্বিতীয় নামটিতে সমকালীন উত্তাপ ও চিরায়ত সুর—দুটোই ধরা আছে। উত্তরে তখন তিনি নিশ্চুপ থাকলেও পরে একদিন বইমেলায় গিয়ে দেখি, তাঁর নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে। শিরোনাম গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান। বুঝলাম, তারুণ্যের অভিমতের প্রতি তাঁর কতটা পক্ষপাত।
আর একদিন বই দেখছি তাঁর ঈর্ষণীয় সংগ্রহের ইতিউতি সেলফে। নতুন একটি বই নেড়েচেড়ে দেখছিলাম; মুস্তাফা নূরউল ইসলামের আত্মজীবনী নিবেদন ইতি। আমার আগ্রহ দেখে কবি বললেন—‘তোমার লাগবে? আমার দুটো আছে। দাও, তোমাকে একটি বই লিখে উপহার দিই।’ বলে কবিতাসম উপহারবাক্যে দিলেন বইটি—‘প্রিয় পিয়াসকে, এই উপহার ভালোবেসে।’ আমি অভিভূত ততক্ষণে। একটু দুঃখ করে বললেন, ‘জানো, অনেকেই আমার ঘরে আসে, না বলে বই নিয়ে যায়, পরে খুঁজতে গিয়ে দরকারি বই পাই না। কেউ যদি চায়, আমি তো দিতেই আগ্রহী বই। বই পড়েই তো এগোবে সময়।’ কবির কথায় আমার ভাবনাও এগোয়।
আরো কোনো একদিনের কথা মনে পড়ে যায়। চট্টগ্রাম থেকে এক তরুণ আলোকচিত্রী কবির ছবি তুলতে এসেছেন। আমিও আছি তাঁর বাসায় তখন। ছবি তোলা শুরু হলো... হঠাৎ কবির চোখ পড়ল আমার দিকে। আলোকচিত্রীকে বললেন, ‘আমার ছবি তুলবে আর আমার তরুণ বন্ধুটি বাদ যাবে, তা তো হয় না। তারও ছবি তুলতে হবে।’ আলোকচিত্রী সম্ভবত বিরক্ত আর আমি বিব্রত। কিন্তু কবি জোর দিয়ে বললেন, তাঁর সঙ্গে আমারও যেন ছবি তোলা হয়। অগত্যা ক্যামেরা তাক হলো আমার দিকেও। ছবি তোলা শেষ হলে সেই আলোকচিত্রীকে বললেন, আমার জন্যও যেন তিনি ছবির কিছু কপি দেন। না, সেদিন তোলা ছবির কোনো কপি পাইনি আমি; কিন্তু কবি শামসুর রাহমানের বিরাটপ্রাণতার ছবি চিরদিনের মতো সংরক্ষিত থেকে যায় আমার মনো-অ্যালবামে।
একবার তাঁর কোন এক জন্মদিনের পরের দিন গিয়েছি আমি। ছোট্ট সেই বাড়িটা সেদিন যেন কবিকে শুভেচ্ছাজ্ঞাপক ফুলের পাহাড়ে রূপ নিয়েছিল। কবির পুত্রবধূ টিয়া আপা সব ফুল-উপহার গুছিয়ে রাখছেন। আমি বিলম্বিত শুভেচ্ছা হিসেবে অতিসাধারণ একটি কলম নিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। উচ্ছ্বসিত কবি টিয়া আপাকে বললেন—সযত্নে তাঁর আলমারিতে কলমটি তুলে রাখতে আর আমাকে মিহি কণ্ঠে অনুরোধ করলেন সেদিনের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর জন্মদিনের খবরগুলো পড়ে শোনাতে। কারণ চক্ষুপীড়ায় তিনি তখন ভুগছেন বেশ। আমি সানন্দে পড়তে শুরু করি। নানান খবরের মাঝে একটি খবর শুনে তিনি কী যে খুশি হলেন! খবরে প্রকাশ—কোনো এক প্রত্যন্ত এলাকায় তরুণ কবিরা তাঁর জন্মদিন পালন করেছে। অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘সবাই আমাকে ভালোবাসে। তাদের কারণেই আমি কবি।’
তারপর অনেক দিন যাওয়া হয়নি শ্যামলীতে। হঠাৎ একদিন পত্রিকায় পড়ি কবির অসুস্থতা বেড়েছে আরো। এক সকালে উদ্বিগ্ন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ফেলে চলি কবিগৃহে। সেদিন এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তাঁকে চোখের ওষুধ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে দ্রুত। এক পলক আমাকে দেখে বললেন, ‘তোমরা তো জানো, আমি কেমন মানুষ। তোমার সঙ্গে বসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু কী যে হয়ে গেল শরীরটার! তোমরা ভালো থেকো।’ সেই শেষ কথা তাঁর সঙ্গে। আশ্চর্য, এর মাঝেও স্বভাবসুলভ আপ্যায়নের কথা ভোলেননি তিনি। আমাকে চা দিতে বলে ঘুমাতে গেলেন তবে।
অতঃপর আগস্ট-২০০৬। কবির জন্য উদ্বেগাকুল দেশজোড়া মানুষ। তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। শাহবাগে দেখা হয় কবি ওবায়েদ আকাশের সঙ্গে। বললেন—রাহমান ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। কবি ফেরদৌস মাহমুদের সঙ্গে দেখা হলে বললেন, ‘চলেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভর্তি কবি। দেখে আসি।’ গেলাম আমরা, যদিও এমন অচেতন অবস্থায় কবিকে দেখতে মন সায় দিচ্ছিল না। যাঁর কবিতা আমাদের চেতনদিশা দিয়ে এসেছে, তাঁকে কি এমন অচেতন অবস্থায় মানায়? তবু গেলাম। দেখলাম, ঘুমিয়ে আছেন সফেদ আত্মার কবিমানুষটি। চলে আসি সেদিনের মতো, শামসুর রাহমানও চলে যান দু-একদিন বাদেই।
একজন কবির মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সারা দেশ। আমার ব্যক্তিগত শোকের সেখানে মূল্য কোথায়! তবু ক্যাম্পাস থেকে ছুটে আসি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, তাঁর বিদায়যাত্রায়। কবির প্রয়াণে এত সুদীর্ঘ শোকযাত্রা ঢাকা যেন ইতিহাস হিসেবে লিখে রাখল সেদিন। এক এলেবেলে তরুণ আমি শোকের সারিতে দাঁড়াই খালি হাতে। কারণ, কোনো ফুল যে তখন আমার প্রকৃত শোক-প্রকাশক; আমি তাৎক্ষণিকভাবে তা বুঝে উঠতে পারিনি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক নেত্রী মতিয়া চৌধুরী, আমার পেছনে জয়পুরহাট থেকে আসা এক সাধারণ মানুষ। ভাবছিলাম, কোন ভালোবাসার জাদুমন্ত্রে প্রয়াত শামসুর রাহমান কেন্দ্র আর প্রান্তের জীবিতদের টেনে নিয়ে এসেছেন শহীদ মিনারে তাঁর রসায়ন বুঝলেই অনুধাবনে আসবে তাঁর রাজসিক কবিতাবিস্তারের সূত্রসার। শহীদ মিনারের শোকযাত্রা শেষ হয় একসময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ থেকে বনানী গোরস্তানে যাওয়ার মুহূর্তে লোকে-লোকারণ্য শবগাড়ির আশপাশ। দূর থেকে ভিড় ঠেলে এগোতে পারছিলেন না সিলেট থেকে আসা কথাশিল্পী প্রশান্ত মৃধা। আমার দিকে গোলাপগুচ্ছ ছুড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, তার শ্রদ্ধার্ঘ্যটুকু কবির বিদায়যানে নিবেদন করে দিতে।
কবি চলে যান বনানীতে মায়ের কবরে। আমি সন্তর্পণে ঢুকে পড়ি কবির স্মৃতির শহর ঢাকায়। যেমন জেমস জয়েসের ডাবলিন, যেমন নগিব মাহফুজের কায়রো, যেমন ওরহান পামুকের ইস্তাম্বুল, যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতা—তেমন শামসুর রাহমানের ঢাকা। কবিহীন ঢাকায় দিনদুপুরে ঘনীভূত অন্ধকারে খুঁজতে থাকি কোথায় তাঁর শৈশবের বাতিওয়ালা! গুলিস্তানের দিকে এক চক্কর দিতে দেখি, নূর হোসেন স্কয়ারে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ বলে শামসুর রাহমান দাঁড়িয়ে, শাহবাগের নিঝুম স্থাপত্য পেরোতে গিয়ে দেখি, সেখানেও শামসুর রাহমান; বলছেন—‘নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ’, সেখান থেকে পাবলিক বাসে, দুঃসহ জ্যাম ঠেলে আসাদগেট অতিক্রম করতে করতে দেখি শামসুর রাহমান বলছেন, ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ শামসুর রাহমানের এভাবে তাঁর স্মৃতির ছায়া বিস্তার করেন ক্রমে আমাদের সত্তার সৈকতে। সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে কবি শহীদ কাদরী মাঝেমধ্যে ফোন করে বলেন, শামসুর রাহমানের সঙ্গে বেশুমার আড্ডার সেই দিনরাত্রির কথা, সৈয়দ শামসুল হক বলেন কখনো—‘এখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি, এটা আমার এক ধরনের অহংকার’—এই একটি পংক্তিতেই চিনিয়ে দেয় শামসুর রাহমানের ভিত্তিভূমি। বেলাল চৌধুরী বলে ওঠেন, ‘বুঝলে মানুষটা খুব অন্য রকম ছিলেন।’ আর এই এপ্রিলের কলকাতা-জার্নিতে রিষড়া থেকে হাওড়ামুখী বাসে দাঁড়িয়ে কবি মৃদুল দাশগুপ্ত আমাদের (আমরা বলতে বন্ধু জুবিন ঘোষ, ঋপণ আর্য, রাজর্ষি মজুমদার, ঋক সৌরক, কৌশিক ভাদুড়ী, সাইরুল) শোনান কলকাতায় শামসুর রাহমানের গল্পগাছি। তরুণ কবি তিনি, বই দিয়েছেন শামসুর রাহমানকে; তিনি পড়ে তাঁকে নিজ থেকে জানিয়েছিলেন তাঁর ভালোলাগার কথা।
কবিবন্ধু সৈয়দ আখতারুজ্জামান আর আমি এক বিকেলে বনানীতে যাই। শুনি কবি ডাকছেন আমাদের, তাঁর নিরালা গৃহকোণে। মা আমেনা খাতুন আর পুত্র শামসুর রাহমান শুয়ে একসঙ্গে। আমরা দেখি কবির শেষবাড়ি। সন্ধ্যা হলে আমরা ফিরে আসি, কিন্তু আবার ফিরে আসিও না, কারণ শামসুর রাহমান নামের কবিতাবাড়ি আমাদের সঙ্গেই থাকে সব সময়।