‘গরু-ছাগলের মতো আমাদের বিক্রি করা হয়েছে’
মানবপাচারকারীর কবল থেকে সম্প্রতি মিয়ানমার নৌবাহিনীর উদ্ধারকৃত ১৪৪ বাংলাদেশির মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি পাবনায়। মাতৃভূমিতে ফিরে শোনালেন তাঁদের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা। পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার টাকায় এক দালাল থেকে আরেক দালালের কাছে বারবার হাতবদল করা হয় তাঁদের।
‘গরু-ছাগল বিক্রি করার মতোই আমাদের অসংখ্যবার বিক্রি করা হয়েছে। দিনে মাত্র আধা প্লেট ভাত আর সামান্য পানি খেতে দেওয়া হত। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করলে আমাদের ওপর নেমে আসত অসহ্য নির্যাতন আর অকথ্য ভাষায় গালাগাল। আল্লাহর কাছে সারাক্ষণ কেঁদেছি, মা-বাবার কাছে যেন আবার ফিরে আসতে পারি।’ গতকাল রোববার এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা সুজানগর উপজেলার খয়রান গ্রামের যুবক মিলন হোসেন।
আরো অনেকের মতোই ভাগ্য বদলের আশায় মানবপাচারকারী দালালদের ফাঁদে পা দেন এই হতভাগ্য যুবক। স্বপ্নেও ভাবেননি, কী ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।
‘জাহাজে পা রাখার পর কখনো ভাবিনি, আবার মায়ের কোলে ফিরে আসতে পারব, দেখতে পারব স্বজনের চেহারা। তারা আমাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে। আল্লাহ আমাদের কান্না শুনেছেন। তাই আবার মায়ের কোলে ফিরে আসতে পেরেছি। পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে পাচ্ছি,’ বললেন মিলন।
মিলন জানান, কৃষিকাজ ফেলে ভালো কাজের আশায় তিনি মানিকগঞ্জে যান। সেখানে এক ইটভাটায় কাজ পান। এ সময় পাবনার বাশার মল্লিক নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মিলনকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দেয় বাশার। এতে কোনো টাকাও লাগবে না বলে মিলনকে আশ্বাস দেওয়া হয়।
বাশারের কথায় রাজি হয়ে পরিবার-পরিজনকে কিছু না জানিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মিলন। পরিকল্পনামাফিক তাঁরা পরদিন চট্টগ্রামে পৌঁছান। এর পর টেকনাফ পৌঁছে মিলনকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয় বাশার।
যদিও তখনো কিছু টের পাননি মিলন। টেকনাফ থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলনকেও নৌকায় তোলা হয়। কিছুদূর গিয়ে সমুদ্রে অপেক্ষমাণ একটি বড় ট্রলারে তুলে দেওয়া হয় মিলনদের। সেই ট্রলারে ২৫০ যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়া রওনা দেওয়ার কথা বলা হয় মিলনকে। ট্রলারটি কিছুদূর যাওয়ার পরই পাচারকারীরা মিলনসহ অন্যদের প্রচণ্ড মারধর শুরু করে। মিলনের পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে পাচারকারীরা। মিলনের বাবা ৪০ হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠালে তাঁকে মারধর করা বন্ধ হয়।
সমুদ্রে ট্রলারে অমানবিক জীবন কাটাতে হয়েছে মিলনদের। দিনে ও রাতে আধা প্লেট করে ভাত দেওয়া হতো। সারা দিনে সামান্য একটু পানি বরাদ্দ ছিল। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কেউ কাঁদলে তাঁকে মারধর করা হতো। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অসুস্থ হয়ে কাতরাতেন অনেকেই।
ট্রলারের প্রধান হামিদ দালাল তাঁদের জানায়, নানা স্থানে বিভিন্ন দামে তাঁদের বিক্রি করা হয়েছে।
মিলন আরো জানান, মানবপাচারকারীরা তাঁদের মালয়েশিয়া পৌঁছানোর নামে সমুদ্রের বিভিন্ন জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকে। এরই মধ্যে মিয়ানমার নৌবাহিনী ট্রলারটি দেখতে পেয়ে তাঁদের উদ্ধার করে।
মিলন হোসেনের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার পাবনায় ফিরে আসা অন্য যুবকরা হলেন উপজেলার ভায়না গ্রামের আলহাজ উদ্দিন, খয়রান গ্রামের নাজমুল হোসেন, বাবুল হোসেন বাবু, ও হাটখালী গ্রামের হক মল্লিক। গত বৃহস্পতিবার সুজানগর থানায় মানবপাচারকারী বাশার মল্লিকের নামে একটি মামলা করেছেন মিলন হোসেন।
সুজানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান জানান, শনিবার রাতে উপজেলার উদয়পুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে সুজানগরের মানবপাচারকারী দলের প্রধান বাছের মল্লিককে (৫০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হাবিবুর রহমান জানান, উপজেলার ভায়না গ্রামের আলহাজ উদ্দিন (২৫), খয়রান গ্রামের মিলন হোসেন (২৪) নাজমুল হোসেন (২৫) ও বাবুল হোসেন বাবু (২২) মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মিয়ানমার উপকূল থেকে আটক হয়ে দেশে ফেরত আসেন। দেশে আসার পর মানবপাচারকারী বাশার মল্লিকসহ পাঁচজনকে আসামি করে সুজানগর থানায় একটি মামলা করা হয়।
সুজানগর থানার ওসি আরো জানান, ওই পাঁচ যুবকসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ২৪-২৫ ব্যক্তি আড়াই মাস আগে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া রওনা হন। এর মধ্যে গত ২২ মে ওই পাঁচ যুবক মিয়ানমার উপকূলে সে দেশের নৌবাহিনীর হাতে আটক হলেও অন্যরা নিখোঁজ রয়েছেন। গত সোমবার যাচাই-বাছাই ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া শেষে মিয়ানমার থেকে এই পাঁচ যুবক দেশে আসার পর ওই দিন কক্সবাজার থানা পুলিশ তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বৃহস্পতিবার তাঁরা বাড়িতে এসে পৌঁছান।
ওসি এও জানান, ওই থানার আরো চার যুবক পাচারকারীদের কবলে পড়ে মালয়েশিয়া রওনা হলেও তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মানবপাচারকারীরা ওই যুবকদের পরিবারের কাছ থেকে এরই মধ্যে নয় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই চার যুবক হলেন সাদ্দাম, বাচ্চু, বাকি ও হানিফ।
সাদ্দামের ভাই রনি জানিয়েছেন, তাঁর ভাই ও অপর তিনজন পরস্পর আত্মীয়। কাজের সন্ধানে তাঁরা ঢাকা গিয়েছিলেন, সেখান থেকে মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে মালয়েশিয়া রওনা হন। দুই মাস ধরে তাঁদের কোনো খোঁজ নেই। ট্রলার থেকে মোবাইলে ফোন করে মুক্তিপণ হিসেবে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করার পরও তাঁদের আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ জানান, এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় উদ্ধার হওয়া জীবিত অভিবাসীদের মধ্যে পাবনা জেলার ৩৮ জনের খোঁজ মিলেছে। পুলিশ যাচাই-বাছাই করে বিষয়টির সত্যতা পেয়েছে।
মিরাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, উদ্ধারকৃতদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে সরকার। তাঁরা দেশে ফিরে আসার পর পাবনার পাচারকারী চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তখন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশ পিছপা হবে না।