সংকট পেরিয়ে কবে প্রত্যাশা পূরণ করবে দেশের রেলসেবা
চট্টগ্রাম থেকে আসা শহিদুর রহমান থাকেন রাজধানীর উত্তরায়; তার পরিবার থাকে বন্দরনগরীতে। এতে প্রায়ই ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করতে হয় তাকে। এই যাতায়াতে ট্রেন তার পছন্দের পরিবহণ। এই বাহনের প্রতি তার আবেগ মিশে আছে।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আমি ট্রেনযাত্রা পছন্দ করি, আমার পরিবারেরও পছন্দ। উত্তরাতে থাকি। ঢাকার মধ্যে যাতায়াতেও মেট্রো ব্যবহার করি,’ ট্রেনযাত্রায় নিজের আগ্রহের কথা বলছিলেন শহিদুর রহমান।
কিন্তু শহিদুর রহমানের এই যাতায়াতে চ্যালেঞ্জও কম নয়। অনেকটা খেদ প্রকাশ করেই বলছিলেন, ‘কাউন্টার থেকে আমি টিকিট কিনতে পারছি না, এমনকি অনলাইনেও না। ফলে কালোবাজারির ওপরই আমাকে নির্ভর করতে হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, কালোবাজারি হলেও আন্তরিকতার সঙ্গে তারা আমার বাসায় টিকিট পৌঁছে দেয়।’
শহিদের মতো বহু মানুষ ট্রেনভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কিন্তু দেশের রেলপথ ব্যবস্থা তাদের এই ভ্রমণকে স্বস্তিদায়ক করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। যাত্রীদের প্রত্যাশার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারছে না তারা।
রেলওয়ে প্রকল্পে এ পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও দেশের যোগাযোগের প্রধানতম এই পরিষেবাটি এখনও অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। ফলে যাত্রীদের কাছে ক্রমেই এটি পছন্দের বাহন হয়ে উঠলেও তাদের প্রত্যাশা পূরণ থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছে ট্রেন যোগাযোগব্যবস্থা।
রেলওয়ে খাতের যত চ্যালেঞ্জ
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৪টি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার আরও ৩২টি প্রকল্প এখনও অসম্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, কাজের ধীরগতি ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দেশের রেলওয়ে খাতের অনেক প্রকল্প ভুগছে। এছাড়া পর্যাপ্ত জনবল ও পুরনো সরঞ্জামের মতো সীমাবদ্ধতা তো আছেই। পাশাপাশি সমন্বিত কৌশলের অভাবে নতুন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অগ্রগতিও কম।
সূত্রের দাবি, ইঞ্জিন, কোচ ও জনবলের ঘাটতি রেল পরিষেবার সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার মতে, বাংলাদেশ রেলওয়ে যে রাজস্ব আয় করে, তা পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্য অপর্যাপ্ত। এর ফলে এই খাতে আর্থিক চাপ বাড়ছে যা রেলসেবার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। তহবিল তছরুপ ও কালোবাজারির কারণে ট্রেনের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমে যাচ্ছে। রেলখাতের অগ্রগতির ধারা ব্যাহত করতে এগুলো বড় ভূমিকা রাখে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক ইউএনবিকে বলেন, চলাচলের জন্য দেশের মানুষের কাছে ট্রেন অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও অদক্ষ কর্মী ও সরকারের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে সংকটে ভুগছে রেলওয়ে খাত।
এর জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সেবা দেওয়ার মানসিকতার অভাবকে দায়ী করেন তিনি।
ড. শামসুলের মতে, রেলওয়ে পরিষেবার উন্নতির পরিবর্তে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রতি ঝোঁক বেশি। আবার নৌপথ, আকাশ ও সড়কপথের পরিবহণে বেসরকারি সংস্থাগুলো মূল ভূমিকা পালন করলেও রেলপথ পুরোপুরি সরকার-নিয়ন্ত্রিত। এর ফলে এই খাতের কর্মীদের রেলের উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও লাভের দিকে মনোযোগ কম, আর সঠিক তদারকির অভাবে নানা পর্যায়ে অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। এতকিছুর পর রেলওয়ে যখন কর্মীদের খরচ তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন সরকারকে আবার ভর্তুকি দিতে হয়। ফলে লাভজনক করার অমিত সম্ভাবনা থাকলেও উল্টো খরুচে খাতে পরিণত হয়েছে রেলওয়ে।
ড. শামসুল হক বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে রেলওয়ে খাত যেখানে যাত্রীসেবার মাধ্যমে লোকসান পুষিয়ে কন্টেইনার পরিবহণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় করে থাকে, বাংলাদেশে সেখানে জবাবদিহিতা ও পেশাদারত্বের অভাবে এই সম্ভবনা কখনও আলোর মুখ দেখেনি।’
এ সময় রেলওয়ের উন্নয়নে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করিয়ে উন্নয়ন তহবিলের অপব্যবহারের মতো কাজের জন্য বিগত সরকারের সমালোচনাও করেন তিনি।
রেলওয়ের উন্নয়নে এই পরিষেবার কাঠামোগত সংস্কার, স্বচ্ছতা ও আংশিক বেসরকারিকরণের সুপারিশ করেন অধ্যাপক শামসুল হক। পাশাপাশি এই খাতের সম্ভাবনাগুলো নির্ণয় করে সেগুলো কার্যকর করতে একটি পেশাদার পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এই প্রকৌশলী। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়, রেলখাতে লভ্যাংশ তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় এর কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের জবাবদিহিতার জন্য গণশুনানির আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে জানিয়ে রেলের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শামসুল হক বলেন, ‘আপনি যদি আউটপুট নিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে (দায়িত্ব থেকে) সরে দাঁড়ান।’
উপদেষ্টার মত
রেলের সংকট কাটাতে নতুন কোনো পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে কিনা—জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ইউএনবিকে বলেন, ‘অতীতে যা ঘটেছে, তা তো আমরা পরিবর্তন করতে পারি না! তবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কাজ করছি। এখন লোকোমোটিভের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহের কাজ চলছে। কোচের সংখ্যা বাড়ানো এবং ওয়ার্কশপ ও মেরামতের সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এ সময় জয়দেবপুর-ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি রুটে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী ২৬ মার্চ ঢাকা-নরসিংদী ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে এই সার্ভিস চালু হওয়ার কথা রয়েছে।’
উচ্চ চাহিদা মেটাতে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে অতিরিক্ত একজোড়া ট্রেন চালু করা হবে বলেও জানান তিনি।
উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আগে রেললাইন ও স্টেশন সম্প্রসারণ করা হলেও ইঞ্জিন ও কোচের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। আমরা আমাদের সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করার চেষ্টা করছি।’
নতুন দিনের সম্ভাবনাময় ঢাকা মেট্রোরেল
রাজধানীবাসীর যাতায়াতের ভোল পাল্টে দিয়েছে সম্প্রতি চালু হওয়া মেট্রোরেল পরিষেবা। ঢাকার নিদারুণ যানজট থেকে মুক্ত করে যাতায়াতে নগরবাসীর স্বস্তি ফেরাতে বর্তমানে এমআরটি-৬ লাইন চালু রয়েছে। এছাড়া আরও পাঁচটি লাইন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
ঘণ্টায় ৬০ হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহণের উদ্দেশ্যে মেট্রোরেলের নকশা করা হয়েছে। গতি, নিরাপদ ভ্রমণ ও স্বস্তিদায়ক পরিষেবার কারণে ঢাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে সময় লাগেনি মেট্রোরেলের। পাশাপাশি, দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা
কম খরচ ও সরাসরি যোগাযোগের কারণে ট্রেন দেশের লাখো মানুষের কাছে একটি অপরিহার্য পরিবহণ।
ঢাকার মিরপুরে বসবাসরত সাংবাদিক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ট্রেনে চড়ার মাধ্যমে যানজটে আটকে থাকতে হয় না। এতে পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে যেমন সুবিধা পাওয়া যায়, তেমনই পরিবারকে বেশি সময় দেওয়া যায়। তাই শহরের (ঢাকা) ভেতরে হোক কিংবা বাইরে, সুযোগ থাকলে ট্রেনেই যাতায়াত করি।’
নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কায়সার আহমেদ বলেন, ‘নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে ট্রেন আমার প্রধান যোগাযোগমাধ্যম। ট্রেনে খরচ কম ও নির্ভরযোগ্য, ফলে প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করা আমার জন্য সহজ হয়। তবে সময়সূচি ও সেবার প্রতি যদি রেল কর্তৃপক্ষ আরেকটু মনোযোগ দেয়, তাহলে আমার মতো হাজার হাজার মানুষ—যারা নিয়মিত ট্রেনে চড়ে—তাদের জন্য আরও সুবিধা হতো।’
ট্রেন যে আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব, তা জাহাঙ্গীর ও কায়সার উভয়েই স্বীকার করেন। তাদের মতে, একই পরিমাণ জ্বালানি খরচে বাস বা অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী ও মালামাল বহন করে ট্রেন। তাই এই খাতের উন্নয়নে সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।
উন্নয়নের সুযোগ
রেলখাতের উন্নয়নে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে ১৮ হাজার ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। রেলওয়ের অবকাঠামো ও আন্তঃনগর পরিষেবার উন্নয়ন এবং কন্টেইনার পরিবহন বাড়ানোর মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য ওই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু দিয়ে নতুন রুট উদ্বোধনের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০ বছর মেয়াদি ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রেলওয়ে খাতে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩৫টি প্রকল্পের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, ৪৪টি জেলাকে এই নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করা এবং গেজ ব্যবস্থাকে মানসম্মত করে পরিচালন সক্ষমতাকে সুবিন্যস্ত করা।
সেই সঙ্গে সড়ক ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে রেলওয়ের সমন্বয়কেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের পরিবহণ ব্যবস্থায় একটি সমন্বিত জাতীয় পরিবহণ কাঠামো তৈরি হবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
উন্নত দেশ থেকে যে শিক্ষা নেওয়ার আছে
রেলওয়ে খাতের উন্নয়নের জন্য বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে বাংলাদেশ। রেল যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নত নিরাপত্তা ও দক্ষতাসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতে জাপানের শিনকানসেনের মান অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ। এছাড়া, পণ্য পরিবহণ আরও সহজ ও লাভজনক করার লক্ষ্যে ভারতের বিশেষায়িত পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
রেলওয়ের মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনার উন্নয়নকল্পে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ অনুকরণীয় হতে পারে। এছাড়া পণ্য পরিবহণে সড়কপথের পরিবর্তে কীভাবে ট্রেনের পরিবেশ ও কৌশলগত সুবিধা গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে ইউরোপের সাফল্য থেকে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের রেলওয়ে-ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গেজ পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও বহুমাত্রিক পরিবহণের সমন্বয়সাধনের জন্য কৌশলগত কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি, বাংলাদেশ রেলওয়েকে বিশ্বমানের পরিবহণ সেবায় পরিণত করতে পরিচালন দক্ষতার উন্নয়ন, কর্মীদের জবাবদিহিতা ও রেলখাতের স্বচ্ছতা বাড়ানো অপরিহার্য।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিসরে ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের কারণে সাশ্রয়ী রেলযোগাযোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন-যাত্রা এগিয়ে নিতে রেলওয়ে খাতে সাফল্যের বিকল্প নেই। এই খাতের সত্যিকারের উন্নয়ন করা গেলে কেবল যোগাযোগ ও পরিবহণ খাতেই গতিশীলতা বাড়বে না, সামগ্রিকভাবে জাতীয় অগ্রগতিতেও এটি অপরিসীম ভূমিকা রাখবে।