জুলাই আন্দোলন নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাল সরকার
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/12/un_report.jpg)
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগ যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়কে (ওএইচসিএইচআর) ধন্যবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আজ বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় আজ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে স্বাধীনভাবে এ তদন্ত করেছে। প্রতিবেদনে গত জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বারা সংগঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উঠে এসেছে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৎকালীন সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। যার মধ্যে রয়েছে কয়েকশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গুরুতরভাবে শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপক হারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতনসহ অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন। ওএইচসিএইচআর যুক্তিসংগত কারণে বিশ্বাস করে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, সমন্বয় ও নির্দেশনায় এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
প্রতিবেদনের আরও বলা হয়, ওএইচসিএইচআরের অনুমান, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মিলিটারি রাইফেল এবং প্রাণঘাতি মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানে নিহত হয়েছেন। এই ধরনের শটগান সাধারণত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।
পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার এবং আটক করা হয়েছিল উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু বলে জানা গেছে। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করেছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিকভাবে আটক-নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন করেছে। বিশেষ করে, শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে। নারীরা যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ছিল লিঙ্গ-ভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি। কয়েকটি ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয়, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি সম্প্রসারিত দল পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে বা ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ ওএইচসিএইচআরকে পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত সরবরাহ করেছে। পুলিশের তথ্যমতে, এই ব্যক্তিরাই বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অস্ত্র সরবরাহ যাদের করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তৎকালীন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা ও সাতজন পুলিশ সদস্য।
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হয়, যেখানে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরও দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে আরও জানা যায়, এর পরদিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং বিশেষভাবে “বিক্ষোভের মূল হোতা”, “গণ্ডগোল সৃষ্টিকারী”দের গ্রেপ্তার, হত্যা এবং হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন’, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে যে অনুসন্ধানকারীরা কাজ করেছেন তাদেরকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। সরকার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এবং নিয়মিত আদালতে সে সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
তবে সরকারের এই প্রচেষ্টা বিভিন্ন মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগে বিদ্যমান কাঠামোগত ত্রুটির কারণে এই প্রচেষ্টার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা পুলিশি অসদাচরণ, যেমন গণহারে মামলা দিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের, অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও স্বপদে বহাল থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার ক্রমাগত ভয় দেখানো, প্রমাণে কারসাজি সেইসঙ্গে আইসিটি এবং নিয়মিত আদালত সম্পর্কিত অন্যান্য যথাযথ প্রক্রিয়াগত জটিলতা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সকল ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে।