নির্বাচনি প্রচারণা করা যাবে ডিজিটাল মাধ্যমে, চরিত্র হনন করলে ব্যবস্থা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর অংশ হিসেবে নির্বাচনি আচরণবিধির নানা বিষয়ে সংশোধন আনছে ইসি। যার খসড়ার কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। খসড়ায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের বিষয়টি। তবে কারও চরিত্র হনন করলে ব্যবস্থা নেবে ইসি। শুধু তাই নয়, প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় প্রতি সপ্তাহে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানানোর বাধ্যবাধকতাও থাকছে।
ইসির তৈরি করা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, ২০২৫-এর খসড়ার বিষয়ে জানেন, এমন একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টার না থাকা, প্রার্থিতা বাতিলের বিধান ও জনসভা করতে পুলিশের অনুমতিসহ নানান বিষয় খসড়ায় যুক্ত করা হচ্ছে। এখন অপেক্ষা খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার। চূড়ান্ত হলে তা প্রকাশ করা হবে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ইসির প্রস্তুত করা নির্বাচনি আচরণবিধিমালার খসড়া পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে চূড়ান্ত করবে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমরা খসড়ার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। আশা করছি, একটি দারুণ আচরণবিধিমালা হবে।
আচরণবিধিমালার খসড়ায় নির্বাচনি ব্যয়সীমা সংক্রান্ত অংশে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা দলের মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে নির্বাচন বিষয়ক কনটেন্ট তৈরি, বিজ্ঞাপন প্রদান, বুস্টিং ও স্পন্সরশিপসহ সকল ডিজিটাল প্রচারণা ব্যয় সামগ্রিক নির্বাচনি ব্যয়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন বরাবর দাখিল করতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে করা সমস্ত ব্যয় প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয়সীমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। সামাজিক মাধ্যমে বিদেশি অর্থায়নে বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে পারবে না। প্রার্থীকে প্রতি ৭ দিন অন্তর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব রিটার্নিং কর্মকর্তা/সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা-বিধি লঙ্ঘিত হলে ডিজিটাল/সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
খসড়ায় নির্বাচনি প্রচারের যে অংশ সেখানে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার এজেন্ট বা অন্য কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট ও ইমেইল আইডিসহ অন্যান্য শনাক্তকরণ তথ্য প্রচার-প্রচারণা শুরুর আগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে। তবে ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারণাকালে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি, কোনো ধরনের তিক্ত বা উস্কানিমূলক বা মানহানিকর কিংবা লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান, কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারে মানহানিকর বক্তব্য প্রচার করলে ডিজিটাল বা সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি হবে। এ ছাড়া ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগেই অনলাইন প্রচারণা থেকে বিরত থাকতে হবে।
খসড়ায় নির্বাচনি প্রচারে ‘পোস্টার’ বাতিল করে ‘ব্যানার’ শব্দ রাখা হয়েছে। ব্যানারের অর্থ বলা হয়েছে কাপড়ের তৈরি প্রচারপত্র। প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহৃত ব্যানার সাদা-কালো রঙের ও আয়তন অনধিক ৩ মিটার বাই ১ মিটার হবে এবং ব্যানারে প্রার্থী তার প্রতীক ও নিজের ছবি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক ছাপাতে পারবে না। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত হলে তিনি তার বর্তমান দলীয় প্রধানের ছবি লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে ছাপাতে পারবে। প্রচারপত্রে পলিথিনের আবরণ বা প্লাস্টিক লেমিনেটিং ব্যবহার করা যাবে না। জনসভার দিন, সময় ও স্থানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টা আগে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। জনসভার কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে স্থান ও সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানাতে হবে। রিটার্নিং অফিসারের নিকট মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ৫ জনের অধিক থাকতে পারবে না। এদিকে নির্বাচনি প্রচারণার জন্য প্রার্থীর ছবি বা তার পক্ষে ক্যাপ ব্যবহার করা যাবে না।
খসড়ায় বিলবোর্ড ব্যবহার সংক্রান্ত অংশে বলা হয়েছে, নির্বাচনি প্রচারণার ক্ষেত্রে কোনো প্রকারের স্থায়ী বা অস্থায়ী বিলবোর্ড ভূমি বা অন্য কোনো কাঠামো বা বৃক্ষ ইত্যাদিতে স্থাপন বা ব্যবহার করা যাবে না। মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দের তীব্রতা ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে রাখার এবং দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। যেটা আগে ছিল রাত ৮টা পর্যন্ত।
খসড়া আচরণবিধিমালায় সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় নতুন করে উপদেষ্টা ও তাদের সমমর্যাদার ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে। আচরণবিধিমালার খসড়ায় নির্বাচনের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন থেকে তফসিল পর্যন্ত সময়কে নির্বাচন-পূর্ব সময়, তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের সময়কে নির্বাচনকালীন সময় এবং ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পর থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময়কে নির্বাচন-পরবর্তী সময় উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারি সুবিধাভোগীদের নির্বাচনি প্রচারণার ক্ষেত্রে খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পূর্বে সভাপতি বা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হয়ে থাকলে বা তৎকর্তৃক কোনো মনোনয়ন প্রদত্ত হয়ে থাকলে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তিনি বা তৎকর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো সভায় সভাপতিত্ব বা অংশগ্রহণ করবে না অথবা উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে জড়িত হবে না। নির্বাচনি প্রচারণার সময়কাল শুরু হওয়ার আগেই উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
খসড়ায় নতুন করে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড কিংবা লিখিত রেকর্ড হতে কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনি এজেন্ট এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছে বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেছে এবং অনুরূপ লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টার জন্য তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হতে পারেন, তাহলে কমিশন বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবে। তদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তির পর কমিশন যদি মনে করেন আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে, সেক্ষেত্রে কমিশন উক্ত প্রার্থীর প্রার্থিতা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধান মোতাবেক বাতিল করতে পারবেন। রাজনৈতিক দলসমূহ এই আচরণবিধির সকল বিধান মেনে চলবে মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র নির্বাচন কমিশনে প্রতীক বরাদ্দের পূর্বে দাখিল করবে।