নারকেলের ছোবড়া, কাপড়ের টুকরা, তুলা আর সুতা- এই সাধারণ উপকরণগুলো দিয়েই বাগেরহাটের নারীরা তৈরি করছেন এমন সব পণ্য, যেগুলো এখন পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। পাখির বাসা, পোষা প্রাণীর ঘর, খেলনা, স্লিপার, ফুলের টবসহ প্রায় ৪০ ধরনের পণ্য যাচ্ছে বেলজিয়াম, জার্মানি ও গ্রিসে।

এই উদ্যোগের পেছনে রয়েছেন স্থানীয় নারী উদ্যোক্তা রোজী আহমেদ। ২০১৯ সালে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে ঘরোয়া উপায়ে পণ্য তৈরির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ২০২০ সালে করোনাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া নারীদের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা থেকে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন ক্ষুদ্র কারখানা ‘মার্সাস অর্গানিক প্রোডাক্ট’। শুরুটা মাত্র ১০–১২ জন নারী নিয়ে হলেও বর্তমানে সেখানে প্রতিদিন কাজ করছেন ৫০–৬০ জন।

তিনতলা ভবনের নিচতলা, একটি একতলা ভবন ও একটি টিনশেড ঘরজুড়ে চলছে পণ্য উৎপাদন। কেউ ছোবড়া কেটে ছাঁচ তৈরি করছেন, কেউ কাপড় সেলাই করছেন, আবার কেউ খেলনায় তুলা ভরছেন। প্রতিটি ধাপে নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য পণ্য।

প্রথম বড় অর্ডার আসে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে, এক হাজার পিস পাখির বাসা। সেই অর্ডারকে সফলভাবে সম্পন্ন করার পরই বাড়ে আস্থা ও উৎপাদনের পরিধি। বর্তমানে এখানে তৈরি হচ্ছে ১৩ ধরনের পাখির বাসা, স্লিপার, ফুলের বাস্কেট, সফট টয়, বিড়ালের ঘর, দোলনা, ব্যাগ, কুকুরের খেলনা, কাঠের টুল, বেবি ভাউচারসহ নানা পণ্য। উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব বাঁশ, কাঠ, তুলা ও সুতা।

নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি করা পাখির বাসা দেখাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা রোজী আহমেদ। ছবি : ইউএনবি

২০২২ সালে প্রথম চালান পাঠানো হয় বেলজিয়ামে। এরপর ২০২৩ সালে গ্রিসে সফট টয় ও স্লিপার রপ্তানি হয়। ২০২৪ সালে জার্মানিতে গেছে দুই হাজার পাখির বাসা। চলতি বছরের মে মাসে গ্রিসে পাঠানো হয় ১১ হাজার জোড়া স্লিপার। বর্তমানে ৬০ হাজার জোড়া স্লিপারের নতুন অর্ডারের কাজ চলছে।

রোজী আহমেদের মতে, কাঁচামালের যোগানই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একসময় বাগেরহাটে প্রচুর নারকেল পাওয়া গেলেও এখন আমদানির প্রয়োজন হয়। এরপরও তার কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দেশি ও বিদেশি বিক্রির পরিমাণ পাঁচ কোটি টাকার কাছাকাছি।

নারকেলের ছোবড়া দিয়ে পাখির বাসা তৈরি করছেন রোজী আহমেদের কারখানার নারীরা। ছবি : ইউএনবি

এই কারখানায় কর্মরত নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরে গর্বিত। কেউ পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন, কেউ সংসারের হাল ধরেছেন। যেমন, কলেজছাত্রী অন্তি ঘোষ দিনে ৪০০ টাকা আয় করছেন। জেনি আক্তার প্রতিদিন প্রায় ২০০ জোড়া স্লিপার তৈরি করে আয় করছেন ৪৫০-৫০০ টাকা। ৬০ বছর বয়সী সাবিত্রী ঘোষ জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর এখানকার কাজেই চলছে তার সংসার।

বাগেরহাট বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. শরীফ সরদার বলেন, ‘রোজী আহমেদ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তার কারখানার পণ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় নারীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

নারকেলের ছোবড়া ও কাপ[ দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন ও পরিবেশবান্ধব স্লিপার। ছবি : ইউএনবি

মো. শরীফ সরদার আরও জানান, রোজী চাইলে বিসিকের পক্ষ থেকে তাকে স্বল্প পরিসরে ঋণ দেওয়া হবে। যদি বড় ঋণের প্রয়োজন হয়, তাহলে ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া হবে। কোনো কারিগরি সহায়তা, নকশা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও তা দিতে প্রস্তুত বিসিক। এমনকি বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনতে চাইলে তাতেও সহযোগিতা করা হবে।