চলচ্চিত্র ‘মুহাম্মদ’ (সা.) ইরানে বিপুল প্রশংসিত
ইরানের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি ‘মুহাম্মদ’ (সা.) গতকাল মুক্তি পেয়েছে। ইসলাম ধর্মের পথপ্রদর্শক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ছেলেবেলার সময়টুকুকে অবলম্বন করে নির্মিত এই ছবি ইরানে দর্শকদের বিপুল প্রশংসা লাভ করেছে। নন্দিত চলচ্চিত্রকার মাজিদ মাজিদি ছবিটি পরিচালনা করেছেন।
নান্দনিকভাবে চিত্রায়িত এই ছবিটির দৈর্ঘ্য ১৭১ মিনিট, এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার কোটি মার্কিন ডলার। ছবিটি আংশিকভাবে অর্থায়ন করেছে দেশটির সরকার। ছবিটি নির্মাণে সময় লেগেছে সাত বছরেরও বেশি।
মাজিদ মাজিদি বিশ্বজুড়ে নামডাকওয়ালা এক পরিচালক। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ছবিটি হতে যাচ্ছে একটি ট্রিলোজির প্রথম পর্ব। এর মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে চান তিনি, উগ্রবাদীদের আচরণে যা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এই কাহিনীর ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আরো দুটি ছবি ছবি নির্মাণ করতে চান তিনি।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের সৌদি আরবের চিত্র বেশ দক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চিরাচরিত মরুভূমিতে উটে সওয়ার আরব বাসিন্দা নয়, বরং এই ছবির চিত্রায়ণ ছিল অনেকটাই বিষয়ানুগ। মহানবীর (সা.) অভূতপূর্ব জন্ম এবং কৈশোরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়টুকু এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দক্ষ নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে।
একটি দৃশ্যে দেখানো হয়, উপজাতীয়দের একটি সশস্ত্র দল পবিত্র মক্কা নগরীর দিকে ধেয়ে আসার পথে একঝাঁক কাকের ছুড়ে মারা পাথরেই ধ্বংস হয়ে যায়। এই দৃশ্যের সঙ্গে সংযুক্ত তীব্র আবহসঙ্গীত প্রশংসনীয়। আরেকটি হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যে দেখা যায়, বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতের অলৌকিক স্পর্শে তাঁর ধাত্রী সুস্থ হয়ে ওঠেন। পুরো ছবিতে মহানবীর মহিমা এভাবেই বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চিত্রায়ন করা হয়েছে।
দর্শকরাও দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন ছবিটি। ‘ছবিটি আমাদের জন্য খুবই প্রেরণাদায়ক’, এভাবে বলেন মাশা রসৌলজাদেহ্। মধ্যবয়স্ক এই নারী তেহরানের একটি সিনেমা হলে তাঁর মা এবং কিশোরী মেয়েকে নিয়ে ছবিটি দেখেছেন।
তেহরান জমজমাট
বেলা ১১টার মধ্যেই জমজমাট হয়ে ওঠে প্রেক্ষাগৃহ। হাউসফুল না হলেও কমতি ছিল না দর্শকের। কিন্তু বেলা গড়াতে না গড়াতেই পরের সব শোর টিকেট ‘সোল্ড আউট’! এমনকি দর্শকদের বাড়তি চাহিদার কারণে শোর সংখ্যা বাড়িয়ে মাঝরাত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরিবারের সবাইসহ পুরো সাতজনের গ্রুপ নিয়ে এসেছিলেন ২১ বছরের তরুণ আবুল ফজল ফাতেহি। তিনি বলেন, ‘ছবিটি ভালো লেগেছে আমাদের সবার। আমার ধারণা, যারা ইসলাম সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানে না, এই ছবিটা দিয়েই তারা শুরু করতে পারে।’
একটি সিনেমা হলের কর্মী মেহ্দি আজর বলেন, ‘ছবিটা লম্বা বলে শুরুতে অনেকের মনে হতে পারে একটু একঘেয়ে, কিন্তু আসলে তা না। ভিজ্যুয়ালি ছবিটা দারুণ আকর্ষণীয়, দর্শককে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে এর।’
মোহাম্মদ মেহদি হেইদারিয়ান প্রযোজিত এই ছবির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে ইরান ও দক্ষিণ আফ্রিকার শহর বেলা-বেলাতে।
বিশাল বাজেটের এই ছবিতে কাজ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারিগরি বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন তিনবার অস্কার জেতা ইতালির ভিত্তোরিও স্তোরেরো, এডিটিং করেছেন ইতালির রবার্টো পেরপিগনানি, স্পেশাল ইফেক্টের কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্কট ই অ্যান্ডারসন, মেকআপ করেছেন ইতালির গিয়ানেত্তো ডি রসি এবং সংগীত সংযোজনে কাজ করেছেন ভারতের অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান।
তবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন নিয়ে নির্মিত ছবি এটিই প্রথম নয়। নন্দিত মার্কিন চলচ্চিত্রকার মুস্তাফা আকদ ১৯৭৬ সালে বানিয়েছিলেন ‘মুহাম্মদ, মেসেঞ্জার অব গড’ নামের একটি ছবি। দারুণ সাফল্যও পেয়েছিল সেই ছবিটি।
তবে সবাই যে এই নতুন ছবিটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তেমন কিন্তু নয়। এদেরই একজন কোমিল আর্জমান্দি। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ পড়ালেখা করছেন ফিল্ম ডিরেকশন নিয়ে। তিনি বললেন, ‘ছবিটা নিয়ে অনেক কথা শুনেছি এতদিন। সত্যি করে যদি বলি, যা দেখেছি তার চেয়ে আমার প্রত্যাশা আরো বেশি ছিল। মুস্তাফা আকদের ছবির চেয়ে এটা আরো উচ্চমানের হবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল আমার।’
নির্মাতারা অবশ্য এই ছবিকে অন্য কোনোকিছুর সঙ্গে তুলনা করতে নারাজ। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও এই ছবিকে আনা হয়নি। এ কারণে ইরানের অন্যতম চলচ্চিত্র উৎসব ফাজর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটিকে প্রতিযোগিতার বাইরে রেখে আলাদাভাবে প্রদর্শন করা হয়।
শিয়া অধ্যুষিত ইরানে ছবিটির পরবর্তী প্রদর্শনীর টিকেটও মোটামুটি সব বিক্রি হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তবে সুন্নি সম্প্রদায়ের কাছে এই ছবিটি বিতর্ক তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ছবির শিল্পীদের নিয়ে পরিচালক মাজিদি এখন কানাডায়, মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছেন তাঁরা। ‘মুহাম্মদ’ (সা.) ছবিটির প্রদর্শনীর মাধ্যমেই পর্দা উঠতে যাচ্ছে এই উৎসবের।