যেভাবে তৈরি হয় ছবির গল্প

অনেকেরই অভিযোগ, গল্পের কারণেই বাংলাদেশে চলচ্চিত্র তেমনভাবে দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে না। আর যারা ভালো গল্পের আশ্বাস দিয়ে হলে দর্শক টানেন, তাঁদের ছবি শুরুর কিছুক্ষণ পরই দর্শক বাকি গল্প বলে দিতে পারেন। অনেকে তো ভারতীয় একটি বা একাধিক ছবির হুবহু নকল করেও ছবি বানিয়ে ফেলেন। অথচ পৃথিবীতে চলচ্চিত্র সমৃদ্ধ হয়েছে মৌলিক গল্প দিয়ে। কারণ একেক জায়গার পরিবেশ একেক রকম, আর সবাই নিজেদের গল্প শুনতেই পছন্দ করেন, নিজেদের জীবনকেই চলচ্চিত্রে দেখতে চান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, “আমরা যখন বাংলাদেশে ছবি বানানো শুরু করলাম, তখন নকল গল্প দিয়ে ছবি বানানোর বিষয়টি আমরা বুঝতাম না। ‘জীবন থেকে নেয়া’ বানানোর সময় চিন্তা ছিল বাংলার মানুষের মাঝে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা। আবার ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ যখন বানাই, তখন আমি প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে এফডিসিতে আসতাম ট্রেনে করে। সকালে খাবার খেয়ে ট্রেনে চড়তাম, দুপুরে এসে এফডিসিতে শুরু হতো আড্ডা। এই আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসত গল্প। আর ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ ছবির গল্পের চরিত্রগুলো আমি প্রতিদিন ট্রেনে দেখতাম। একসময় সবাই আমার পরিচিত হয়ে গেল, কারণ প্রতিদিন একসাথে ঢাকায় আসতাম আর রাতে বাড়ি ফিরতাম। ছবি হচ্ছে জীবনের গল্প আর আমরা যেহেতু বাংলাদেশে বাস করি, আমাদের ছবি বানতে হবে বাংলাদেশের গল্প নিয়ে। বিদেশি গল্প বাংলাদেশের মানুষ দেখবে না।”
চলচ্চিত্রে গল্প বলা বিষয়ে পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বলেন, ‘আমি ছবি বানানোর আগে চিন্তা করি ছবিতে কাদের গল্প বলব। পুরো গল্পটা নিজের মধ্যে নিয়ে নিই। তারপর দৃশ্যগুলো লেখা শুরু করি, গল্পটা লেখা শুরু করলেই পরের বিষয়গুলো এমনিতেই আসতে থাকে। গল্প তৈরি করার পর প্রযোজকের সাথে বসি। প্রযোজকদের কিছু চিন্তাভাবনা থাকে, সেগুলোকে যুক্ত করে তৈরি হয় চিত্রনাট্য। আমার বেলায় যেটা হয়, আমি প্রযোজকদের সাথে বসে আমার গল্পটা যুক্তি দিয়ে দাঁড় করাই আর যাঁরা ছবি প্রযোজনা করেন, তাঁরাও অনেক অভিজ্ঞ। তাদের সাথে কথা বললে গল্পটা আরো সমৃদ্ধ হয়। আর যাঁরা নকল গল্প নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা আসলে আমাদের বাজারটা নষ্ট করছে।’
পরিচালক কাজী হায়াৎ বলেন, ‘আমি সব সময় ছবি বানাই নিজের চোখে দেখা ঘটনা নিয়ে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, যে বিষয়টি দেখেনি সে ওই বিষয়ে গল্প বলতে পারবে না। যেমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক প্রেক্ষাপট, আমাদের জীবনের প্রেক্ষাপট তুলে আনাই আমার ছবির মূল উদ্দেশ্য। সব সময় বর্তমান সময়ের গল্প বলতে চেষ্টা করি। বাংলাদেশের ছবির বাজার ফিরে পেতে চাইলে আমাদের জীবনের গল্প নিয়ে ছবি বানাতে হবে। অন্য দেশের গল্প নিয়ে ছবি বানালে আমাদের দেশের মানুষ দেখবে না।’
নকল ছবি প্রসঙ্গে কাজী হায়াৎ বলেন, ‘যাঁরা হলে গিয়ে ছবি দেখেন, তাঁরা টেলিভিশনও দেখেন। আর আমাদের দেশে যে ছবির গল্প নকল করে সেটা টিভিতে দর্শক অনেকবার দেখে ফেলেন আগেই। যে কারণে দর্শক বিরক্ত হয়ে যান নকল ছবি দেখলে। তাঁরা এখন সহজেই নকল ছবি ধরে ফেলতে পারেন। এ বিষয়ে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে সেন্সর বোর্ডের। আমাদের সেন্সর বোর্ডে যে ১২ জন কাজ করেন, এঁদের অনেকে হয়তো বিদেশি ছবি দেখেন না। যে কারণে তাঁরা বলতে পারেন না এটা বিদেশি গল্পের নকল। আমার মনে হয়, এই ১২ জনের মধ্যে চারজনের একটি মনিটরিং সেল থাকা দরকার, যাঁরা দেখবেন এটা নকল ছবি কি না। কারণ এই নকল গল্প আমাদের ছবির বাজার নষ্ট করেছে।’
পরিচালক এফ আই মানিক বলেন, ‘বাংলাদেশে ছবির গল্প তৈরি হয় তিনভাবে। প্রথমত, পরিচালক নিজের চিন্তা থেকে গল্প তৈরি করেন। ১০ জন প্রযোজকের সাথে আলাপ করলেও নিজের গল্প বদলাতে চান না। দ্বিতীয় পথ হলো, প্রযোজক একটা গল্প হাতে নিয়ে চিন্তা করেন, এই ধরনের গল্প নিয়ে ছবি বানাবেন। তখন প্রযোজক গল্প অনুযায়ী পরিচালককে ডেকে এনে বলেন, তাঁর ওই গল্প থেকে বানিয়ে দিতে হবে। শুরু হয় চিত্রনাট্য তৈরির কাজ। তৃতীয় একটি দল আছে, যাঁরা নকল ছবির বানান। কিছু অসাধু চিত্রনাট্যকার আছেন, যাঁরা কয়েকটি বিদেশি ছবির গল্প নিয়ে একটা গল্প বানাতে চেষ্টা করেন। এর মূল কারণ তাঁদের নিজের কোনো মেধা নেই। বাংলাদেশের ছবির বাজার হারানোর অন্যতম একটি কারণ নকল ছবি। আশা করছি, যারা নকল ছবি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা এই অবস্থান থেকে সরে আসবেন।’
চলচ্চিত্র নির্মাণে ভালো গল্পের যেমন বিকল্প নেই তেমনি মৌলিক গল্পকেও বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করে দর্শক। তাই ভালো ও মৌলিক গল্প হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভালো ব্যবসা করবে বলে মনে করেন অনেক চিত্রপরিচালক।