ঘুমের সময় ১১ ‘রহস্যময় ঘটনা’
সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের কোনো জুড়ি নেই। কঠোর পরিশ্রমের পর কিছুক্ষণের জন্য নিদ্রাদেবীর সান্নিধ্য পরবর্তী কাজের জন্য মানুষকে উদ্যমী করে তোলে। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও এই ঘুম কিন্তু যথেষ্ট রহস্যময়। কারণ, ঘুমন্ত অবস্থায় একজন মানুষের সঙ্গে ঘটে যেতে পারে ১১ ধরনের রহস্যময় ঘটনা। চলুন, জীবনধারাবিষয়ক ওয়েবসাইট ব্রাইটসাইডের সৌজন্যে জেনে নিই সেই ১১ ধরনের রহস্যময় ঘটনা সম্পর্কে।
১. স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা
যে রকম অনুভূতি হয় : আমাদের দেশে বোবায় ধরা বেশ পরিচিত একটি ঘটনা। স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা ব্যক্তির রাতে ঘুম ভেঙে যায় এবং তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এর সঙ্গে নানা রকম ভয়ংকর স্বপ্নের মুখোমুখি হতে হয় আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে। যদিও অনেকে একে খারাপ আত্মা বা দুষ্টু জিনের কারসাজি মনে করেন। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে।
কেন ঘটে : সাধারণত যখন কেউ ঘুমায়, তখন তার শরীর অসাড় হয়ে যায়। ফলে ঘুমের মধ্যে ব্যক্তিটি হাত-পা নড়াচড়া করতে পারে না। কিন্তু স্লিপ প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে শরীরের পেশিগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিলেও মস্তিষ্ক জেগে থাকে। গড়পড়তা ৭ শতাংশ মানুষ জীবনে একবার হলেও স্লিপ প্যারালাইসিসের খপ্পরে পড়েন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, যখন তাঁরা চিৎ হয়ে ঘুমিয়েছেন, তখনই তাঁরা স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
২. হিপন্যাগজিক হ্যালুসিনেশন বা সম্মোহনী বিভ্রান্তি
যে রকম অনুভূতি হয় : এ ঘটনা ঘটে যখন একজন ব্যক্তি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় ব্যক্তিটি অদ্ভুত ও ভুতুড়ে দৃশ্য বা চেহারা দেখতে পায়।
কেন ঘটে : মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিরও সম্মোহনী বিভ্রান্তি হতে পারে, তখন সে অমূলক জিনিস দেখে বিশ্বাস করতে থাকে। প্রায়ই এ হ্যালুসিনেশন শিশুদের সঙ্গে ঘটে। ফলে সহজে শিশুরা ঘুমাতে চায় না। অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে অমূলক জিনিস দেখার যে সমস্যা, সেটি হতে পারে। এ ছাড়া মাতাল অবস্থায় ঘুমাতে গেলে এ ধরনের সম্মোহনী বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৩. স্লিপ টকিং বা ঘুমের মধ্যে কথা বলা
যে রকম অনুভূতি হয় : বোবায় ধরার মতো বাংলাদেশে এটিও বেশ পরিচিত একটি ঘটনা। এ ঘটনাকে সাধারণ ইংরেজিতে বলা হয় ‘সমনিলোকুই’ (somniloquy)। সমনিলোকুইতে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে কথা বলেন, কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় ঘুমের মধ্যে কথা বলার বিষয়টি তার মনে থাকে না। মনোবিদদের মতে, এটি মানসিকভাবে অতটা মারাত্মক নয়, যতক্ষণ না ঘুমের মধ্যে ব্যক্তিটি কোনো গোপন কথা ফাঁস করে দিচ্ছে।
কেন ঘটে : নারীদের তুলনায় পুরুষ ও শিশুদের ঘুমের মধ্যে কথা বলার প্রবণতা বেশি। সম্মোহনী বিভ্রান্তির মতো ঘুমের মধ্যে কথা বলার প্রধান কারণ হচ্ছে মানসিক চাপ।
৪. আ ড্রিম উইদিন আ ড্রিম বা স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন
যে রকম অনুভূতি হয় : ‘আ ড্রিম উইদিন আ ড্রিম’ পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি ঘুম থেকে ওঠেন, কিন্তু অদ্ভুত বা ভুতুড়ে জিনিস তাঁর সঙ্গে ঘটতেই থাকে। কিন্তু শেষমেশ দেখা যায়, সেটাও আসলে ঘুমের ভেতরেই হচ্ছিল, স্রেফ একটা স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখার ঘটনাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ‘ইনসেপশন’ ছবিটির কাহিনী। বক্স-অফিসে ছবিটির সফলতার পর অনেকেই তাঁদের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটার দাবি করেছেন।
কেন ঘটে : অনেকেই বলেন, এ ধরনের স্বপ্ন মানুষের আত্মিক অনুশীলনকে ইঙ্গিত করে। তবে বিজ্ঞান এখনো এ ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
৫. স্লিপ ওয়াকিং বা ঘুমের মধ্যে হাঁটা
যে রকম অনুভূতি হয় : স্লিপ প্যারালাইসিসের বিপরীতধর্মী একটি ঘটনা হলো স্লিপ ওয়াকিং বা ঘুমের মধ্যে হাঁটা। স্লিপ ওয়াকিংয়ে সচেতন মন ঘুমালেও শরীরের পেশিগুলো তখনো জেগে থাকে। ঘুমের মধ্যে যে কেউ হাঁটতে পারে, ঘর পরিষ্কার করতে পারে, এমনকি ঘর ছেড়ে বাইরেও চলে যেতে পারে। প্রায়ই যা বিপজ্জনক আকার ধারণ করে। তবে সকালে স্লিপ ওয়াকিংয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির এ ব্যাপারে কিছুই মনে থাকে না।
কেন ঘটে : স্লিপ ওয়াকিংকে ইংরেজিতে আদর করে ‘সোমনামবুলিজম’ ডাকা হয়। কমবেশি সব দেশেই ঘুমের মধ্যে হাঁটা ব্যক্তির দেখা মিলবে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে হাঁটার প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। এর প্রকৃত কারণ এখনো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি এর চিকিৎসার উপায়ও আবিষ্কার করতে পারেনি আধুনিক বিজ্ঞান।
৬. এক্সপ্লোরিং হেড সিনড্রোম বা মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ
যে রকম অনুভূতি হয় : এক্সপ্লোরিং হেড সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির হঠাৎ জোরে কোনো আওয়াজ বা তালির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। মাঝেমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিটি কিছুক্ষণের জন্য বধির হয়ে যান। এর সঙ্গে যোগ হয় ক্রমাগত বাড়তে থাকা গুঞ্জন। এ ধরনের ঘটনা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। এটি মানুষকে ভীত করে তোলে। আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর স্ট্রোক হয়েছে।
কেন ঘটে : বিভিন্ন কারণে এক্সপ্লোরিং হেড সিনড্রোম হতে পারে। সাধারণত মস্তিষ্কের শব্দ নিয়ন্ত্রণের অংশে কোনো ধরনের ঢেউ বা আন্দোলনের ফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া অনিদ্রা বা বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি থেকেও এক্সপ্লোরিং হেড সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৭. স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া
যে রকম অনুভূতি হয় : স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মস্তিষ্ক অক্সিজেনের অভাব বোধ করার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায়। ফলে ঘুমের হার হ্রাস পায়। এ ধরনের ঘটনায় ধমনিতে চাপ পড়ে। এতে করে হৃদরোগজনিত সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
কেন ঘটে : ঘুমের মধ্যে গলার ভেতরের মাংসপেশি শিথিল অবস্থায় থাকে। যা মাঝেমধ্যে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। যাদের অতিরিক্ত ওজন রয়েছে, ধূমপায়ী ও যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব, তাদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
৮. রিকারিং ড্রিমস বা একই স্বপ্ন বারবার দেখা
যে রকম অনুভূতি হয় : প্রায় প্রত্যেকেরই একই স্বপ্ন বারবার দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। রিকারিং ড্রিমসে আক্রান্ত ব্যক্তি একই স্বপ্ন অবিরত দেখতে থাকেন।
কেন ঘটে : মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, এ ধরনর ঘটনা তখনই ঘটে, যখন অচেতন মনের কাছে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিষয়টি সমাধান হওয়ার আগপর্যন্ত মানুষ একই ধরনের স্বপ্ন দেখতে থাকে।
৯. ফলিং অনটু দ্য বেড বা ঘুমের মধ্যে ওপর থেকে বিছানায় পড়া
যে রকম অনুভূতি হয় : ফলিং অনটু দ্য বেডে আক্রান্ত ব্যক্তিটি প্রায়ই অনুভব করেন, উঁচু থেকে কেউ তাঁকে বিছানার ওপর ছুড়ে মেরেছে। বিছানা স্পর্শ করামাত্র তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে। এ ছাড়া ঘুমের মাঝে অনেক উঁচু বা আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার স্বপ্নও দেখে, এটাও একই সিনড্রোমের আওতাভুক্ত।
কেন ঘটে : ঘুমের সময় আমাদের হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা কমে যায়। পেশিগুলো শিথিল অবস্থায় চলে যায়। মস্তিষ্ক এমন সুপ্ত অবস্থায় চলে যায় যে সে নিজেই জানতে চায়, ব্যক্তিটি জীবিত আছে, না মারা গেছে। পরীক্ষা করার জন্য মস্তিষ্ক পেশিকে সংকেত পাঠায় আর আক্রান্ত ব্যক্তিটির মনে হয়, তিনি ঘুমের মধ্যে ওপর থেকে বিছানায় পড়েছেন।
১০. আউট অব বডি এক্সপেরিয়েন্স বা নিজেকে নিজেই ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা
যে রকম অনুভূতি হয় : এটি একটি নিউরোসাইকোলজিক্যাল ফেনোমেনন বা স্নায়ুমনোস্তত্ত্বধর্মী ঘটনা। আধো ঘুম বা আধো জাগরণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। আউট অব বডি এক্সপেরিয়েন্সে আক্রান্ত ব্যক্তিটি নিজেকে তাঁর দেহের বাইরে আবিষ্কার করেন। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার আলোকেই স্বপ্নে নিজেকে অন্যের জায়গায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মানুষ।
কেন ঘটে : আউট অব বডি এক্সপেরিয়েন্স কেন ঘটে, তা বিজ্ঞানীদের কাছেও পরিষ্কার নয়। বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন, নিজেকে দেহের বাইরে আবিষ্কার করার ভ্রম মানুষের সঙ্গে প্রায়ই ঘটে, তবে এর সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সঠিক ব্যাখ্যা এখনো বিজ্ঞানীরা দাঁড় করাতে পারেননি।
১১. সাডেন এনলাইটেনমেন্ট ডিউরিং স্লিপ বা স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান
যে রকম অনুভূতি হয় : বাজারে স্বপ্নে প্রাপ্ত মহৌষধের কথা অনেকেই জানেন, যদিও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তবে স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞানের অস্তিত্ব রয়েছে। অনেক দিন ধরে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, হাজার চেষ্টা করেও যার সমাধান করা যায়নি, মস্তিষ্ক ঘুমের মধ্যেই সে সমস্যা সমাধানের একটি সূত্র দিয়ে বসে। তবে সেটা মনে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ঘটনা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, সাডেন এনলাইটেনমেন্ট ডিউরিং স্লিপের প্রভাবেই রুশ রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলিফ পর্যায় সারণি আবিষ্কার করেছিলেন। একইভাবে অগাস্ট কেকুলেও ঘুমের ভেতর সতেজ মস্তিষ্কের সহায়তায় পেয়েছিলেন বেনজিনের গঠন-সংক্রান্ত ধারণা।
কেন ঘটে : দীর্ঘদিন ধরে একটি সমস্যা নিয়ে ভাবলে সেটির সমাধান তৈরি হয়ে যেতে পারে অচেতন মনের ভেতর। কিন্তু তা সচেতন মন পর্যন্ত পৌঁছায় না। কিন্তু স্বপ্নের ভেতরেই সেই অচেতন মন থেকে উত্তরটি প্রকাশ পায়। তখনই সাডেন এনলাইটেনমেন্ট ডিউরিং স্লিপের মতো ঘটনা ঘটে।