মেকাপের আগে একবার ওদের কথা ভাবুন
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/10/14/photo-1444807164.jpg)
যুগ যুগ ধরে নারীর সৌন্দর্যচর্চার প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে লিপস্টিক, ফেসপাউডারের মতো সামগ্রীগুলো। সাজতে পছন্দ করেন এমন যেকোনো নারীর কাছেই এসব উপাদান ভীষণ প্রিয়। অথচ বেশির ভাগ নারীই জানেন না, এই লিপস্টিক-পাউডার তৈরির পেছনে কত মানুষের কত অবদান আর কান্না লুকিয়ে থাকে।
চলুন এই দফা ঘুরে আসি ভারতের ঝাড়খন্ডের পাহাড়ি এলাকা থেকে। এখানে একসময় খনি ছিল। সেখান থেকে উত্তোলন করা হতো বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রায় দুই দশকে আগে খনিগুলো সরকারিভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই খনিগুলোর ওপর নির্ভর করত যে মানুষগুলোর আয় রোজগার, তাদের কী হবে? এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের বেঁচে থাকার বিকল্প উপায়ই বা কী।
সরকারিভাবে কাগজ-কলমে খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও এগুলোর আশপাশে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত পড়ে আছে তার ওপরে এখনো নির্ভর করে টিকে আছে কিছু মানুষ। আর এখন খনিতে যারা কাজ করছে তারা প্রায় সবাই শিশু। যাদের এখন স্কুলে যাওয়ার বয়স তারা খনির গর্তের ভেতরে ঢুকে বের করে আনছে বিশেষ ধরনের খনিজ পদার্থ মিকা। আর এই মিকা বিক্রি করেই সংসার চালাতে হচ্ছে তাদের।
ঝাড়খণ্ডের এক পরিত্যক্ত খনিতে এএফপির সঙ্গে কথা বলে আট বছরের শিশু ললিতা কুমারী। সেই সময় তার সারা শরীরভর্তি ছিল ধুলো-ময়লা, মাথার চুল ঘামে জট পাকানো। ললিতার কাজ খনি থেকে মিকা সংগ্রহ করা। ছোট্ট শিশু ললিতা পাহাড় আর খনির গর্তের ভেতরে ঢুকে যে পাথরগুলো কষ্ট করে বয়ে আনছে সেগুলো কী কাজে লাগে জানেন?
আপনার সাজগোজের অনুষঙ্গ লিপস্টিক আর নেইল পলিশের জেল্লা বাড়াতে ব্যবহার করা হয় এসব পাথরে থাকা খনিজ উপাদান মিকা। বিশেষ ধরনের কিছু সিলিকেট-জাতীয় খনিজ পদার্থ যাদের রাসায়নিক গঠন একই রকমের তাদের একসঙ্গে বলা হয় মিকা। ওজনে হালকা, তুলনামূলক নরম এবং মিকার পাতগুলো হয় বেশ নমনীয়। এই খনিজ পদার্থগুলো তাপ প্রতিরোধক এবং বিদ্যুৎ অপরিবাহী।
মিকা বিভিন্ন রঙের হয়। যেমন : বেগুনি, গোলাপি, রুপালি, ধূসর, গাঢ় সবুজ, খয়েরি, কালো, হলুদাভ বাদামি, সাদাটে সবুজ ইত্যাদি। এ ছাড়া কিছু কিছু মিকা বর্ণহীন হয়, আবার স্বচ্ছও হয়। এই মিকাই ব্যবহার করা হয় লিপস্টিক, মাশকারা, নেইল পলিশ বা ফেস পাউডারে।
চকচকে বালুময় পাহাড়ের গর্তে বসে একটি বড় নিশ্বাস নেয় ললিতা। জানায়, সেই চার বছর বয়স থেকেই ঝাড়খণ্ডের এই পাহাড়ের গর্ত থেকে পাথর তুলে আনার কাজ করছে সে। এই কাজ ছাড়া আর কীভাবে বেঁচে থাকা যায় সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তার।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার এক ফাঁকে নিজের ফোসকা পড়া হাত দুটি জামার পেছনে লুকিয়ে ফেলে ললিতা। সে বলে, ‘আমি স্কুলে যেতে চাই। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কখনোই পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার থাকে না। সে জন্য আমাকে এখানে আসতে হয় এবং কাজও করতে হয়।’
ললিতা সেই শতাধিক শিশুর একজন, যাকে এই খনিতে এসে ভীষণ পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হয় যেন তার পরিবার কোনোমতে খেয়ে বাঁচতে পারে। তবু অনেক সময় যখন গনগনে সূর্যটা মাথার ওপর এসে তেজ ছড়ায় তখনো হয়তো খালি পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে খনি থেকে পাথর সংগ্রহে ব্যস্ত থাকতে হয় ললিতার মতো শিশুদের।
পরিবেশ ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর কর্মীরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় প্রসাধনী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এত হাত ঘুরে এই মিকা সংগ্রহ করে যে এর উৎপত্তি খুঁজে পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ বিখ্যাত প্রসাধনীগুলো তাদের মিকা যে আসলে কোথা থেকে সংগ্রহ করে সেই উৎসটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না।
বেশির ভাগ সময় এসব শিশুর পরিবারগুলো বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে সংগ্রহ করা মিকা বিক্রি করে দেয়। পরে সেই ব্যবসায়ীরা আবার বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে তা বিক্রি করেন।
২০০৯ সালে জার্মানির বিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তারা বিভিন্ন খনি থেকে শিশুদের মাধ্যমে মিকা সংগ্রহ করে এবং ল’রেল ও রেভলনের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তা বিক্রি করে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে মার্ক ঘোষণা দেয় যে, ‘আমাদের বিভিন্ন প্রসাধনীর জন্য যেসব রঞ্জক পদার্থ সংগ্রহ করা হয়, তার সবই আসে শিশুশ্রমমুক্ত উৎস থেকে।’
তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেসব মিকা সংগ্রহ করা হয় তা যে শিশুশ্রমের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় না সে বিষয়টি কখনোই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না।
ভারতের নোবেলজয়ী সমাজসেবী কৈলাস সত্যার্থীর সংস্থা ‘বাচপান বাঁচাও’-এর সদস্য ভুবন রিভু এএফপিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এই অঞ্চল থেকে যে বা যারাই মিকা সংগ্রহ করে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এটা খেয়াল রাখা যে, শিশুরা যেন মিকা সংগ্রহের কাজ না করে স্কুলে লেখাপড়া করে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের সরবরাহকারীকে শিশুশ্রমের ভিত্তিতে মিকা সংগ্রহকে নিরুৎসাহিত করা।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ল’রেল এএফপিকে জানায়, ভারতে মিকার প্রধান সরবরাহকারী হচ্ছে মার্ক। তারা যে আইনগতভাবে সঠিক স্থান থেকে মিকা সরবরাহ করে সে প্রমাণ মার্ক ল’রেলকে দিয়েছে।
ভারতে ১৮ বছরের নিচের শিশুশ্রম বেআইনি হলেও প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই আইন শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি
মিকা সংগ্রহের সময় এর ধুলা ও গুঁড়া শিশুদের চোখে ও নিশ্বাসের সঙ্গে বুকে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সেই সঙ্গে সংগ্রহ করার জন্য পাহাড়ের গর্তে প্রবেশের সময় আহত হওয়ার ঝুঁকি তো থাকছেই। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে সাপের কামড় খাওয়ার ভয় ও পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়।
তবে এত কিছুর পরও দরিদ্রতার কারণে শিশুদের স্কুলের চেয়ে খনিতে পাঠাতেই আগ্রহী থাকেন তাদের বাবা-মায়েরা। তা ছাড়া কাগজ-কলমে যেহেতু খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেহেতু এ বিষয়ে প্রতিকার বের করতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে।
মিকা সংগ্রহ করে কী পরিমাণ উপার্জন করে এসব শিশুর পরিবারগুলো? কয়েকজন শিশুর বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই খনিতে কাজ করাই তাদের জীবিকার মূল উৎস। এদেরই একজন শিবু যাদব। যার চার সন্তান খনিতে কাজ করে। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘যদি খনি থেকে মিকা তোলার বিষয়টা না থাকত তাহলে হয়তো আমাদের বেঁচে থাকাই হতো না।’
যাদব জানান, মিকা সংগ্রহ করে তার পরিবার মাসে এক হাজার রুপির মতো আয় করতে পারে।
তবে সুদিন আসছে। ইশটি লাউডার ও শ্যানেলের মতো পৃথিবী বিখ্যাত প্রসাধনী নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলো কৈলাস সত্যার্থীর সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে এসব এলাকার শিশুদের শিক্ষার পেছনে। ১৩ বছর বয়সী সীমা কুমারী তাই ভীষণ খুশি। সে লেখাপড়া করতে চায়। তার জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া। তবে এটাও বলতে হবে যে সীমার ভাগ্য ভালো। অন্য শিশুদের মতো তার স্বপ্নও কুঁড়িতেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে না।
হাতে-মুখে মিকার গুঁড়ো আর ধুলো লেগে থাকা ১৩ বছরের পুষ্প কুমারী বলল, ‘আমি জানি মিকা পাউডার আর লিপস্টিক তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যবহার করলে মেয়েদের অনেক সুন্দর দেখায়। অথচ দেখুন এটা আমার কী হাল করেছে?’