আপেল বনের দেশে

কাশ্মীর উপত্যকার অন্যতম অর্থকরী পণ্য আপেল। হিমালয় পর্বতমালার নিচের দিকে ছোট ও মাঝারি টিলায় হাজার হাজার একর জমিতে আপেলের বাগান। একই চেহারার, ছোট ছোট, সারি সারি কাঁলচে গাছের গুঁড়ি, গাঢ় সবুজ পাতা, ধবধবে সাদা ফুল, দূরে পর্বতের চূড়ায় তুষারের সাদা টুপির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যেন, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রোদ-ছায়ার খেলা- সব মিলে দেখতে সত্যিই মনোরম। রোববারের ছুটিতে সাউথ কাশ্মীরের আপেল বাগানগুলোর এই দৃশ্য দেখে এলাম। এখন মে মাস। আপেল গাছে ফুল ফোটে মার্চ-এপ্রিলে। শীতের শেষ হয়ে বসন্ত যখন আসে, তখন। বাংলাদেশের বসন্তে আমের বাগানে আসে সোনালি মুকুল। কাশ্মীরে আপেলগাছে ধরে সাদা ফুল। এখন ফুল প্রায় ঝরে গেছে। দু-একটা গাছে দেরিতে ধরেছে ফুল। সেগুলোর দেখা পেলাম। পর্বতের গা বেয়ে নেমে আসা অসংখ্য ঝরনার শীতল পানি পেয়ে আপেলগুলো বেড়ে ওঠে।
কাশ্মীরি ভাষায় আপেলকে বলা হয় ‘চুঁওট’। শীতল আবহাওয়ায় এর ফলন হয় বলে একে বলা হয় টেম্পরেচার ফ্রুটস। দুই মাস পরেই তাদের দেখা যাবে হাটবাজারে। আগস্ট থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত গাছ পাকা তাজা আপেল কেনা যাবে। তখন কাশ্মীরের বাজারে দাম হবে প্রতি কেজি ১০-২০ রুপি। শ্রীনগর থেকে জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ে ধরে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে দুটি জেলার নাম অনন্তনাগ (স্থানীয়রা বলে ইসলামাবাদ) আর কুলগাঁও। এই দুই জেলায়ই উৎপন্ন হয় সবচেয়ে বেশি এবং উন্নত জাতের আপেল।
একটা প্রাইভেটকারে চড়ে গেলাম কুলগাঁও জেলার পাফাড় গ্রামে। সমতল পেরিয়ে গাড়ি চলছিল পাহাড়ি রাস্তায়। কোথাও খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। কোথাও আবার নেমেছে নিচে। রাস্তা বেয়ে গাড়িটি যখন নিচে নামছিল তখন মনে হলো যেন, সামান্য পিছলে গেলেই সব শেষ! একেবারে গিয়ে পড়ব পর্বতের পাদদেশে। আতঙ্ক কাটাতে জানালা দিয়ে তাকালাম বাঁ দিকে। সবুজের হাতছানি আমাকে ভুলিয়ে দিল রাস্তার ভয়ঙ্কর বাঁক। সরু রাস্তার তীর ঘেঁষে শুরু হয়েছে আপেল, আলম আর ওয়ালনাটের বাগান। একেবারে পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে যেন সাজানো সবুজ গালিচা। তারপর আবার পাশের পাহাড়ের গা-বেয়ে উঠে গেছে সুউচ্চে। মাঝে মাঝে ঝাউগাছও চোখে পড়ল। ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল দু-একটি ছোট্ট টিনের ঘর। ড্রাইভার জানাল, পর্বতের ওই রেঞ্জের নাম পীর-পাঞ্জাল (হিমালয়ের মাঝারি পর্বতমালার অংশ)।
পরে গেলাম ইসলামাবাদ জেলায়। এর দাপ্তরিক নাম অনন্তনাগ। কাশ্মীরি ভাষায় নাগ মানে হলো ঝরনা। অনন্ত মানে অসংখ্য। শব্দ দুটি সংস্কৃত থেকে এসেছে বলেই মনে হয়। কাশ্মীরি ভাষায় সংস্কৃত, উর্দু ও ফার্সি ভাষার শব্দ আছে অনেক। ওই জেলায় অসংখ্য ঝরনার দেখা মেলে। তাই তার ওই নাম বলে কথিত আছে। ওখান থেকেই প্রবাহিত হয়েছে ঝিলাম নদীর মূল শাখা। ওখানে এক পর্বত পেরিয়ে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল প্রায় ৩০০ ক্যানাল (৪০ একর) আয়তনের এক আপেলবাগান। পরে জেনেছি ওটা কাশ্মীরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্চার্ড (ফলবাগান)। ওখানকার একেকটি আপেলগাছের বয়স হয়েছে প্রায় ৪০ বছর। সারিবদ্ধ গাছগুলো দূরে পর্বতের চূড়া থেকে দেখতে অপূর্ব। প্রতিটি গাছ প্রায় একই রকমের।
মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, গাছের মূল কাণ্ড ঠিক রেখে ডালপালা কেটে দেওয়া হয় প্রতি দুই বছর অন্তর। প্রতিটি গাছের চারপাশে সমানসংখ্যক ডালপালা রাখা হয়, যাতে সূর্যের আলো এবং বাতাসের সংস্পর্শ পায় সবগুলো ফল। এ কারণেই সব ফল হয় প্রায় সমান আকৃতির। আপেলের ভারে ডাল ভেঙে পড়া ঠেকাতেও নেওয়া হয় এসব ব্যবস্থা। ওই বাগানের ভেতরে ঢুকে কয়েক মিনিট মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। লক্ষ করলাম, যে কোনো দিক থেকে তাকালে গাছগুলো সারিবদ্ধ দেখায়। পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে প্রতিটি গাছের গায়ে লাগানো হয়েছে জিপসাম (চুন)। ওই সাদা চুনের কারণে আপেলবাগানটি যেন আরো রূপসী হয়ে উঠেছিল। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের অর্থনৈতিক রিপোর্ট অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপন্ন হওয়া মোট আপেলের পরিমাণ ৫০ হাজার টন। এগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেশে-বিদেশে বাজারজাত করা হয়। কিছু শুকিয়ে বিক্রি করা হয়, কিছু বানানো হয় জুস। তবে, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের বন্যায় আপেল শিল্পের ক্ষতি হয়েছে মারাত্মক। এ বছরের এপ্রিলের ফের অতিবৃষ্টির কারণে আপেলের কুঁড়ি ঝরে পড়েছে অনেক। ফলে এ বছরও আপেলের ফলন নিয়ে শঙ্কায় আছে মানুষ।