করটিয়া জমিদারবাড়ি কেন যাবেন?
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/01/22/474006326_1425431475501000_4846896326300606496_n.jpg)
টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী এবং দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্য করটিয়া জমিদার বাড়ি অন্যতম। বয়সের দিক দিয়েও করটিয়া জমিদারবাড়ি টাঙ্গাইলের অন্যান্য জমিদারবাড়ির চেয়ে এগিয়ে, অর্থাৎ বলা যায় টাঙ্গাইলের প্রাচীন জমিদারবাড়ি এটি।
ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়ার স্মৃতিবিজড়িত টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদারবাড়িটি টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শহর থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটির পরিবেশ অত্যন্ত প্রাকৃতিক এবং নিরিবিলি। নির্মল পরিবেশে বাংলার গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আজও শক্ত পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৪০০ বছরেরও অধিক প্রাচীন এই জমিদারবাড়ি। পন্নী পরিবারের সন্তান সা’দত আলী খান পন্নী ১৭ শতকের প্রথমদিকে করটিয়ায় বসবাস শুরু করেন আর তখন থেকেই তাঁরা করটিয়ার জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
সা’দত আলী খান ছিলেন পন্নী বংশের ১১তম পুরুষ। আটিয়ার চাঁদ নামে ইতিহাসের বই থেকে জানা যায়, আফগান অধিপতি সোলায়মান খান পন্নী কররানির ছেলে বায়েজিদ খান পন্নী ভারতে আগমন করেন। তাঁর ছেলে সাইদ খান পন্নী আটিয়ায় বসতি স্থাপন এবং ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে আটিয়ার বিখ্যাত মসজিদ নির্মাণ করেন। সা’দত আলী খান পন্নী টাঙ্গাইলের করটিয়ায় এসে পন্নী বংশের ভিত প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে জমিদার সা’দত আলী খান পন্নী সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে জটিলতায় মামলায় জড়িয়ে পড়েন। ঢাকার জমিদার খাজা আলীমুল্লাহর সহায়তায় তিনি পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করেন, কিন্তু শর্ত ভঙ্গের কারণে পাল্টা মামলা করে খাজা আলিমুল্লাহ ভোগ-স্বত্বের ডিক্রি লাভ করেন। তখন সা’দত আলী খান সম্পত্তি রক্ষার জন্য স্ত্রী জমরুদুন্নেসা খানমের নামে তা দানপত্র করে দেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে আপস মীমাংসা হয়। সা’দত আলী খান সম্পত্তির সাত আনা অংশ খাজা আলীমুল্লাহকে ছেড়ে দেন। অতঃপর বাংলা ১২২৭ সনের ৯ পৌষ সা’দত আলী খান এবং তাঁর স্ত্রী জমরুদুন্নেসা খানম যৌথভাবে একটি দলিল করেন।
সা’দত আলী খান তাঁর স্ত্রী জমরুদুন্নেসা খানম যৌথভাবে একটি দলিল করেন। এতে সমস্ত সম্পত্তি দুটি ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগ পরিবারের ব্যয় ও অন্য ভাগ ওয়াকফ্ করে ধর্মীয় ও দাতব্য কাজে ব্যয় করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।
ওয়াকফ্ সম্পত্তি দেখাশুনা করার জন্য মুতাওয়াল্লী নিয়োগের বিধান রাখা হয়। সাদত আলী খান পন্নীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী মুতাওয়াল্লী ছিলেন। মাহমুদ আলী খান পন্নীর মৃত্যুর (১৮৯৬) পর মুতাওয়াল্লী কে হবেন এ নিয়ে তাঁর পুত্র ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) এবং পিতামহী জমরুদুন্নেসা খানমের মধ্যে বিবাদ ও মামলা মোকদ্দমা সংঘটিত হয়। পরিশেষে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী জয়ী হন এবং দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2025/01/22/473705856_912575230864121_5918562118504621845_n.jpg)
ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) ছিলেন করটিয়া জমিদারকুলের সবচেয়ে স্বনামধন্য। চাঁদ মিয়া ছিলেন পন্নী বংশের ১৩ তম পুরুষ। তিনি একজন দানবীর জমিদার ছিলেন। বিভিন্ন সুকীর্তির জন্য তিনি আতিয়া চাঁদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি জমিদারি সম্প্রসারণসহ প্রজাদের সকল সুযোগ সুবিধা প্রদানে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯০১ সালে করটিয়াতে হাফেজ মাহমুদ আলী ইনস্টিটিউশনটি স্থাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে করটিয়াতে নিখিল বাংলা মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ। ১৯১০ সালে চাঁদমিয়া করটিয়াতে আয়োজন করেন মুসলিমএডুকেশন কনফারেন্স। তিনি ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সহসভাপতি ছিলেন।
তিনি বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে ১৯২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর কারাবদ্ধ হন। তাঁর অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আজও লন্ডন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর তৈলচিত্রের নিচে লেখা রয়েছে 'ওয়ান হু ডিফাইড দি ব্রিটিশ।' ১৯২২ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং বাংলার আলীগড় নামে খ্যাত ১৯২৬ সালে করটিয়ায় সা'দত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের পাশাপাশি তিনি স্থাপন করেন রোকেয়া সিনিয়র মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে করটিয়া জমিদার বাড়িটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রেমী দর্শনার্থীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। জমিদার বাড়ির মহলগুলোর স্থাপত্যশৈলী এতবছর পরও আমাদের মুগ্ধ করে এবং বিস্মতও করে। এর স্থাপত্যকর্মে মূলত মোঘল ও চৌনিক স্থাপত্য রীতি মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। পুরো জমিদার বাড়িটি দেয়াল দ্বারা ঘেরা। এর ভেতরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রাচীন ফলজ ও ভেষজ বৃক্ষ। জমিদার বাড়ির ভেতর হাঁটার সময় আপনার নজরে পড়বে মোগল আমলের দামী আসবাবপত্র সহ জমিদারদের ব্যবহার্য নানান সামগ্রী। রয়েছে একটি প্রাচীন মসজিদ, রোকেয়া মহল সহ আরও বহু স্থাপত্যকর্ম। এতসব জমিদারী সামগ্রী দেখে নিজকে কিছুক্ষণের জন্য নবাব ভাবতে পারেন।
যাতায়াত
দেশের যেকোন জায়গা থেকে প্রথমে বাসস্ট্যান্ডে নামবেন। তারপর স্থানীয় যানবহনে চড়ে জমিদার বাড়ির কথা বললেই আপনাকে অল্প সময়েই সেখানে নিয়ে যাবে। তাহলে এবারের ঈদে আপনিও ঘুরে আসুন ঐতিহ্যের এই মহাকীর্তি করটিয়া জমিদার বাড়িতে।
কোথায় থাকবেন
এখানে আপনি থাকতে পারেন টাঙ্গাইলের বেশ কিছু হোটেলে। শহরের কলেজ পাড়ায় এ হোটেল গুলো অবস্হিত। এছাড়া জেলা প্র্রশাসকের অনুমতি নিয়ে আপনি বাঙলোতে থাকতে পারেন ।আবার আপনি দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে পারেন ।
প্রতিদিন দেশিবিদেশি শতশত পর্যটকের পা পড়ে এই জমিদারবাড়ির আঙিনায়। তারা আসে, দেখে, জানে এবং একরাশ প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যায়।