ট্রাম্প-জেলেনস্কির উত্তেজনাপূর্ণ ১০ মিনিটে কী কথা হলো?
হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির তীব্র বাগবিতণ্ডা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার ইউক্রেনীয় প্রতিপক্ষকে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে চাপ দিয়ে বলেন, ‘তা না হলে আমরা (ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে) বেরিয়ে যাব।’
ওভাল অফিসে শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষর-পূর্ব আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়েই দুই নেতা মিডিয়ার সামনে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন।
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বিষয়ে শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জেলেনস্কির সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এরপর দেশটির সঙ্গে খনিজসম্পদ চুক্তি ঘিরে ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও আলোচনায় ফেরার প্রথম ধাপ বলে মনে করা হচ্ছিল। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বছরের পর বছর ধরে দেওয়া মার্কিন সহায়তার জন্য ইউক্রেনের কাছ থেকে আরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবি করার পর ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বিশ্ব গণমাধ্যমের সামনে ভিন্ন এক রূপে দেখা গেছে।
বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পরামর্শ দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জেডি ভ্যান্স। কিন্তু জেলেনস্কি তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিক্রিয়ায় তারা জানান, তিনি (জেলেনস্কি) ‘অসম্মানজনক’ আচরণ করছেন।
উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র বাগবিতণ্ডার পর জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলা হয় এবং উভয় প্রেসিডেন্টের মধ্যে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে উভয় দেশের মধ্যে প্রত্যাশিত খনিজ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়নি। হোয়াইট হাউস থেকে জেলেনস্কির গাড়ি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘যখন তোমরা শান্তির জন্য প্রস্তুত হবে, তখন ফিরে এসো।’
বৈঠকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এখানে চারটি সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরা হলো।
জেলেনস্কি ও ভ্যান্সের মধ্যে উত্তেজনা
শুরুতে আধঘণ্টা সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা ও আনুষ্ঠানিকতা চলাকালে ওভাল অফিসে উত্তেজনা শুরু হয় যখন ভ্যান্স বলেন, ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ সম্ভবত কূটনীতির মাধ্যমে সম্পৃক্ত হওয়া। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটাই করছেন।’
এর মধ্যেই জেলেনস্কি ভ্যান্সকে থামিয়ে দিয়ে তিন বছর আগে পূর্ণ মাত্রার আক্রমণের আগের বছরগুলোতে রাশিয়ার আগ্রাসনের কথা বলতে থাকেন। এসময় জেলেনস্কি ২০১৯ সালে একটি যুদ্ধবিরতি চেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘কেউ তাকে (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) থামায়নি।’
‘জেডি, কোন ধরনের কূটনীতির কথা বলছেন? কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’, প্রশ্ন করেন জেলেনস্কি। এরপর ভ্যান্স জবাব দেন, ‘যে ধরনের কূটনীতি আপনার দেশ ধ্বংসের অবসান ঘটাবে।’
এরপর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে মার্কিন গণমাধ্যমের সামনে অসম্মানজনক আচরণ ও পরিস্থিতি খারাপ করার জন্য অভিযোগ করেন।
যুদ্ধের অবসানের জন্য ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ভ্যান্সের সমর্থন ও পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দ্রুত যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেওয়ায় প্রথমে ইউক্রেনীয় নেতার সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
‘আমাদের কী অনুভব করতে হবে তা বলে দিও না’
ভ্যান্স ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে সামরিক বাহিনী ও সেখানে নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার পর জেলেনস্কি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সবারই সমস্যা থাকে, এমনকি আপনারও। কিন্তু আপনার কাছে একটি সুন্দর সমুদ্র আছে এবং এখন এটি অনুভব করছেন না। তবে ভবিষ্যতে আপনি এটি অনুভব করবেন।’ জেলেনস্কির এই মন্তব্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করে।
এক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় নেতা ইঙ্গিত করেন, ট্রাম্প ইউক্রেনে আক্রমণকারীদের সঙ্গে মোকাবিলার নৈতিক বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। ট্রাম্প যুদ্ধকে দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরনের দ্বিমুখী সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা পোষণ করেন। ট্রাম্প মনে করেন, উভয়পক্ষেরই যুদ্ধ এবং এর কারণগুলোর জন্য দায়-দায়িত্ব নেওয়া উচিত। কিন্তু জেলেনস্কি এই চিন্তাভাবনার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করছিলেন। ইউক্রেনীয় নেতা ওভাল অফিসে ট্রাম্পকে সরাসরি এই কথাটি বলেন, রাশিয়াকে যদি সন্তুষ্ট করেন যুদ্ধ একদিন আপনার কাছেই ফিরে আসবে।

এতে ট্রাম্পকে সবচেয়ে উচ্চস্বরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা দেয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের কী অনুভূতি হবে তা বলে দিও না। তুমি এটা নির্ধারণ করার মতো অবস্থানে নেই।’
জেলেনস্কির উদ্দেশে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘তোমার কাছে এখন কার্ড নেই। তুমি লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছো।’
‘তুমি একা ছিলে না’
কথোপকথনের একপর্যায়ে, জেলেনস্কি বলেন, ‘যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা একা ছিলাম এবং আমরা কৃতজ্ঞ।‘ এতে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন, যিনি বারবার যুদ্ধকে আমেরিকান করদাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টির একটি কারণ হিসেবে তুলে ধরেন।
বাইডেনকে ইঙ্গিত করে ট্রাম্প বলেন, ‘তুমি একা ছিলে না। আমরা তোমাকে একজন বোকা প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছি।’
এরপর জেলেনস্কি কথা বলতে শুরু করলে ট্রাম্প বিরক্ত হয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোমার দেশ বড় সমস্যায় পড়েছে। তুমি জিততে যাচ্ছো না, তুমি জিতবে না। আমাদের কারণে তোমার ভালোভাবে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
‘শুধু বলো, ধন্যবাদ’
ট্রাম্প বলেন, ‘এভাবে কাজ করা খুব কঠিন। এটি একটি কঠিন চুক্তি হতে চলেছে, কারণ মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে তিরষ্কার করেন। তার ‘মনোভাব’ দেখে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ভ্যান্স একপর্যায়ে বলে বসেন, ‘শুধু বলো, ধন্যবাদ।’
উভয়পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার একপর্যায়ে দেশটিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওকসানা মারকারোভাকে মাথায় হাত দিতে দেখা গেছে। জেলেনস্কির গতকাল শুক্রবারের মতো ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অর্থ কিন্তু শেষপর্যন্ত পুতিনের কাছে হারকেই ত্বরান্বিত করতে পারে।