গাজায় খাদ্য সহায়তার নামে ‘ইচ্ছাকৃত গণহত্যা’, নিহত ৩

গাজায় তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত তিনজন ফিলিস্তিনি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। ইসরায়েলি অবরোধে তিন মাসের মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র এ ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার (২৭ মে) দুপুরে রাফাহ শহরে তীব্র রোদের মধ্যে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)-এর খাবার নিতে ভিড় করেন। ফাউন্ডেশনটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সম্প্রতি গঠিত হয়েছে এবং এর কার্যক্রম শুরু করেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। খবর আল জাজিরার।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, খাবারের আশায় ভিড় করা জনতার ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালায়। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানায়, “এই ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের সমান। ৯০ দিনের অবরোধে ক্ষুধার্ত মানুষদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। তারা সাহায্যের আশায় এসেছিল।”
ঘটনাস্থলে ইসরায়েলি সামরিক হেলিকপ্টার ও গুলির শব্দ শোনা যায়। এক ফিলিস্তিনি বাবা বলেন, “আমরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি। বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে। কিছু না পেলে মরার মতো অবস্থা হবে।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অবশ্য দাবি করেছে, তারা সরাসরি কোনো গুলি চালায়নি, বরং সতর্কতামূলক গুলি ছোড়া হয়েছে। তারা আরও জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সহায়তা বিতরণ অব্যাহত থাকবে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এবং ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গঠিত জিএইচএফ ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনার মুখে পড়েছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, “এইভাবে সহায়তা পৌঁছানো যায় না। আমরা এবং আমাদের অংশীদাররা বহুদিন ধরে একটি কার্যকর ও মানবিক পরিকল্পনা তৈরি করেছি, যেটি বাস্তবায়নেই সংকট কাটানো সম্ভব।”
জিএইচএফ-এর বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের মুখপাত্র আহমেদ বায়রাম বলেন, “এটি এক নিষ্ঠুর এবং বেপরোয়া পরিকল্পনার পরিণতি। আমরা এমন দৃশ্যের বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিলাম।”
জিএইচএফ যেখানে মাত্র চারটি “মেগা সাইট” চালু করেছে, সেখানে আগে জাতিসংঘের মাধ্যমে পুরো গাজা জুড়ে ৪০০টি বিতরণ কেন্দ্র ছিল। কেন্দ্রগুলোর সংখ্যা কমে যাওয়ায় দক্ষিণ গাজায় জনসমাগম বেড়েছে এবং এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে।

জিএইচএফ বিতরণ করা খাদ্যসামগ্রীতেও রয়েছে প্রশ্ন। মধ্য গাজার দিয়ার আল-বালাহ থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খুদারি জানিয়েছেন, প্রতিটি প্যাকেটে থাকে মাত্র চার কেজি আটা, কিছু পাস্তা, দুইটি বিনসের ক্যান, কিছু চা ব্যাগ ও বিস্কুট। এসব খাবার একটি পরিবারের জন্য অপ্রতুল।
একইসঙ্গে জিএইচএফ-এর মাধ্যমে বায়োমেট্রিক চেহারা শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন নজরদারির ভয়ও তৈরি করেছে।
জিএইচএফ-এর প্রধান ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন, তিনি বলেন সংস্থাটি “নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা ও স্বাধীনতা”—এই মানবিক মূলনীতিগুলো মানতে ব্যর্থ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও সামরিক কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠকের মাধ্যমেই জিএইচএফ গঠিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর মতে, উত্তরের গাজাবাসীকে দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই ইসরায়েলের পরিকল্পনার অংশ, যাতে জনসংখ্যার স্থানচ্যুতি ঘটানো যায়।

আন্তর্জাতিক সাহায্যকর্মীরা বলছেন, জিএইচএফ-এর পরিকল্পনা বন্ধ করে দ্রুত সীমান্ত খুলে দিয়ে জাতিসংঘ ও অভিজ্ঞ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সহায়তা বিতরণই এখন একমাত্র মানবিক পথ।