তেহরানে ফেরা স্বর্গের মতো, কিন্তু যুদ্ধবিরতি টিকবে কতদিন?

১২ দিনের যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তাই তেহরানের রাস্তায় আবার মানুষের ভিড় বাড়ছে। যারা শহর ছেড়ে পালিয়েছিল, তারা এখন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধে ৬০০ জনেরও বেশি ইরানি মারা গেছেন, ঘরছাড়া হয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ।
তেহরানে ফিরে আসা অনেকের কাছে এটা ‘স্বর্গের মতো’ লাগছে। কারণ এতদিন পর নিজেদের বিছানায় ঘুমানোর সুযোগ মিলেছে। কিন্তু মনে একটা ভয়ও কাজ করছে—আবারও কি বোমা হামলা শুরু হবে?
যুদ্ধ শুরুর পর দুই সপ্তাহ আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ৩৩ বছর বয়সী গ্রাফিক ডিজাইনার নিকা বলেন, ‘এতদিন পর বাড়ি ফেরাটা স্বর্গের মতো। কিন্তু জানি না যুদ্ধবিরতি কতদিন টিকবে।’
কীভাবে শুরু হলো এই যুদ্ধ?
১৩ জুন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এরপর ইরানও পাল্টা হামলা শুরু করে। এতে তেহরানের কেন্দ্রে সরাসরি যুদ্ধ হয়, যা কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম। ইসরায়েলি হামলা বাড়তে থাকলে আমেরিকান ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা তেহরান ছাড়ার কথা বলায় জীবন বাঁচাতে অনেকে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান।
২৬ বছর বয়সী ছাত্রী সাবা বলেন, যুদ্ধের আগে তার জীবন ছিল খুবই ব্যস্ত। পড়াশোনা, চাকরি আর নিজের ঘরের কাজ সামলাতেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সব বন্ধ হয়ে যায়। ‘প্রথমে আমার পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে গেল, তারপর অফিস থেকে বাড়ি থেকে কাজ করতে বলল, আর একে একে আমার সব বন্ধু তেহরান ছেড়ে চলে গেল। আমি ভীষণ একা অনুভব করতাম’, বলেন সাবা। রাতে যখন বোমার শব্দ শুরু হতো, তখন আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারতেন না। পরে তার বাবা কুচান থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান।
রাতগুলো ছিল অসহনীয়
রাজধানীর একটি বেসরকারি সংস্থার ব্যবসায়ী ও সিইও কামরান তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমি তেহরানে থাকা ও কোম্পানিটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বোমাবর্ষণ ও বিমান প্রতিরক্ষার শব্দ ছিল, কিন্তু দিনের বেলা জীবন নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে রাতগুলো সত্যিই অসহনীয় ছিল।’ দুই সন্তানের জনক কামরান এভাবেই যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেন।
যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতেই অসংখ্য মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। কিন্তু এই যাত্রাও সহজ ছিল না। তাদের দুটি বড় বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পেট্রোল পাম্পগুলোতে দীর্ঘ লাইনের কারণে জ্বালানি সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল, শহর থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান সড়কগুলো ভারী যানজটের কারণে আটকে গিয়েছিল।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
সবাই অবশ্য সাবা বা নিকার মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ কেভান সাকেত যখন আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন জানতে পারেন তার বাড়িতে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। বোমাটি না ফাটলেও তার বাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দরজা, জানালা ভেঙে গেছে, বাড়ির সামনের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে আমি যুদ্ধকে ঘৃণা করি।’

যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও শান্তি এখনও নিশ্চিত নয়। দু’পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে চুক্তি ভাঙার অভিযোগ করছে। ইরান বলছে, ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে, আর ইসরায়েল বলছে তারা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। এতে আবার নতুন করে সংঘাত শুরুর ভয় বাড়ছে।
এই অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও তেহরানের রাস্তাগুলো এখন অনেক ব্যস্ত। অনেক কোম্পানি কর্মীদের আবার অফিসে ডেকেছে, আর শহর আবার আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। যদিও শহরের অনেক জায়গায় ক্ষতির চিহ্ন রয়েছে, তবুও মানুষের চোখে এক ধরনের সতর্ক আশা দেখা যাচ্ছে।