গাজায় প্রতিদিন গড়ে ২৮ ফিলিস্তিনি শিশু মারা যাচ্ছে : জাতিসংঘ

ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার বোমাবর্ষণ ও মানবিক সহায়তা সরবরাহে নিষেধাজ্ঞার কারণে গাজায় প্রতিদিন গড়ে ২৮ শিশু নিহত হচ্ছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) মঙ্গলবার এক্স-এর এক পোস্টে এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজায় শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে নানা কারণে বোমা হামলায়, পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ও অনাহারে। এছাড়া, জরুরি সাহায্য ও অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্রের অভাবেও শিশুরা মারা যাচ্ছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, গাজায় প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন শিশু মারা যাচ্ছে, যে সংখ্যা একটি ক্লাসরুমের শিক্ষার্থীর সমান।
সংস্থাটি জোর দিয়ে বলেছে, গাজায় শিশুদের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও সুরক্ষার জরুরি প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো এখনই যুদ্ধবিরতি কার্যকর।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে গাজায় ৬০ হাজার ৯৩৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও এক লাখ ৫০ হাজার ২৭ জন আহত হয়েছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েল এ পর্যন্ত ১৮ হাজারেরও বেশি শিশু হত্যা করেছে, যা প্রতি ঘণ্টায় একজন শিশু হত্যার সমান।
গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় খাবারের অভাবে এক শিশুসহ কমপক্ষে আটজন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। ইসরায়েল ত্রাণ আটকে রেখেছে ও ত্রাণপ্রার্থীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এতে অনাহারে মৃতের সংখ্যা বেড়ে এখন ১৮৮ জনে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ৯৪ জনই শিশু।
আল জাজিরার প্রতিবেদক আকসেল জাইমোভিচ বলেছেন, যারা বেঁচে আছেন, তাদের শৈশব জীবনের মৌলিক বিষয়গুলোর জন্য প্রতিদিনই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি শিশু কাদিম খুফু বাসিম জানান, তার বাবা আহত হয়ে মিশরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাকে ছয়জনের একটি পরিবারের ভরণপোষণ করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। বাসিম বলেন, আমি ফুটবল খেলতে ভালোবাসি। কিন্তু এখন আমি কুকি বিক্রি করি। আমার শৈশব চলে গেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের আর কোনো শৈশব অবশিষ্ট নেই।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, বাসিমের মতো শিশুদের যুদ্ধের প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়ার কথা। কিন্তু গাজায়, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এই শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাইমোভিচ বলেন, স্কুলগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, পানির ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতিগতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিশুদের শৈশবের মৌলিক অধিকার ... শিক্ষা, খেলাধুলা, সঠিক পুষ্টি ... পুরো একটি প্রজন্মের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের যুদ্ধ শিশুদের ওপর মানসিক ক্ষতও ফেলে দিচ্ছে। ১০ বছর বয়সী বাস্তুচ্যুত শিশু লানার চুল ও ত্বক প্রায় রাতারাতি সাদা হয়ে গেছে, যা ডাক্তাররা ট্রমা-প্ররোচিত ডিপিগমেন্টেশন বলে অভিহিত করেছেন। তার মা মাই জালাল আল-শরিফ আল জাজিরাকে বলেন, লানা এখন আত্মগোপনে, প্রায়শই কেবল তার পুতুলের সঙ্গে কথা বলে... তার মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এনজিও সেভ দ্য চিলড্রেনের আঞ্চলিক পরিচালক আহমেদ আলহেন্দাউই বলেন, গাজা আজ শিশুদের ও তাদের স্বপ্নের জন্য একটি কবরস্থান... এটি এমন একটি প্রজন্ম যারা বড় হচ্ছে এই ভেবে যে বিশ্ব তাদের পরিত্যাগ করেছে।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুসারে, ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন মাত্র ৮৬ ট্রাক ত্রাণ অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে, যা জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ৬০০ ট্রাকের মাত্র ১৪ শতাংশ। সাহায্যের এই অভাব গাজায় এক অভূতপূর্ব দুর্ভিক্ষের দিকে পরিচালিত করেছে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও ১৫০ টিরও বেশি মানবিক সংস্থা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, যাতে সাহায্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় ও হারানো প্রজন্ম হিসেবে অভিহিত মানসিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।