ট্রাম্পের শুল্ক ঝড়ে কেঁপে উঠেছে ভারতের হীরক শিল্প

ভারতের গুজরাটের সুরাট শহরের ছোট্ট একটি কারখানায় ৩৫ বছর বয়সি কালপেশ প্যাটেল প্রায় ৪০ জন কর্মী নিয়ে অপরিশোধিত হীরা কেটে পালিশ করে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করেন। তবে ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তার আট বছরের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি তৈরি করেছে।
প্যাটেল বলেন, “দীপাবলির জন্য কিছু অর্ডার আছে, কিন্তু শুল্কের কারণে রপ্তানিকারকেরা অর্ডার বাতিল করলে উৎসবের আগেই কারখানা বন্ধ করতে হতে পারে।” খবর আল জাজিরার।
সুরাটকে বলা হয় ‘ডায়মন্ড সিটি অফ ইন্ডিয়া’, এখানে প্রায় ২০ হাজার ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশ্বে উৎপাদিত প্রাকৃতিক হীরার মধ্যে ১৫টির মধ্যে ১৪টিই কাটে ও পালিশ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৪.৮ বিলিয়ন ডলারের কাটা ও পালিশ করা হীরা রপ্তানি করেছে, যা মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
শুল্ক ও রপ্তানি সংকট
ট্রাম্প ২ এপ্রিল সব ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, যা ৭ আগস্ট কার্যকর হয়। এরপর ৬ আগস্ট তিনি অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা দেন, যা ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। ফলে হীরক শিল্পের জন্য কার্যকর শুল্ক দাঁড়াবে ৫২.১ শতাংশ। এই সিদ্ধান্তকে “ভণ্ডামি” বলে অভিহিত করেছেন গ্লোবাল রিসার্চ ট্রেড ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব, কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজেও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ চীনের মতো বড় তেল ক্রেতাকে কোনো শাস্তি দেয়নি।

হীরক শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি আঘাত
সুরাট, আহমেদাবাদ ও রাজকোটের হীরা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করে। কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার কাঁচা হীরার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় এই শিল্পে মন্দা দেখা দিয়েছে। গুজরাট ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি রমেশ জিলরিয়া জানান, গত দুই বছরে অর্থনৈতিক সংকটে প্রায় ৮০ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন এবং মজুরি অর্ধেকে নেমে মাসে ১৫-১৭ হাজার রুপিতে ঠেকেছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, শুল্ক কার্যকর হলে ২ লাখ মানুষ কর্মহীন হতে পারেন।
শিল্প নেতারা বলছেন, কৃত্রিমভাবে তৈরি ‘ল্যাব-গ্রো’ হীরার দাম প্রাকৃতিক হীরার তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ, যা ক্রেতাদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফলে প্রাকৃতিক হীরার বাজার সংকুচিত হচ্ছে।

রপ্তানিতে পতন
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ১০.৮ বিলিয়ন ডলারের কাঁচা হীরা আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৪.২৭ শতাংশ কম। একই সময়ে কাটা ও পালিশ করা হীরার রপ্তানি ১৬.৭৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৩.২ বিলিয়ন ডলার। জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল (জিজেইপিসি) বলছে, শুল্ক কমানো না হলে রপ্তানি ও কর্মসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দেশীয় বাজার ও নতুন গন্তব্য
শিল্প নেতারা মনে করছেন, দেশীয় চাহিদা বাড়ানো এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো নতুন বাজার খোঁজা জরুরি। বর্তমানে ভারতের রত্ন ও গয়না শিল্পের বাজারমূল্য ৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা দুই বছরের মধ্যে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে সুরাটের ব্যবসায়ী কালপেশ প্যাটেলের মতো উদ্যোক্তারা সতর্ক করছেন, সহায়তা ছাড়া এই শিল্প “চিরতরে জৌলুস হারাবে”।