গাজা গণহত্যায় যুক্তরাজ্যের ভূমিকা স্পষ্ট : রাজা চার্লসের সাবেক উপদেষ্টা

অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা করা ৭৫ বছর বয়সী পরিবেশবাদী জনাথন পোরিট গাজায় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং যুক্তরাজ্যকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় "সহযোগী" বলে আখ্যায়িত করেছেন। সম্প্রতি ফিলিস্তিন অ্যাকশন নামক আন্দোলনকারী সংগঠনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে অংশ নেওয়ায় তাকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী গ্রেপ্তার ও অভিযুক্ত করা হয়।
এ মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভে তিনি একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন, যেখানে লেখা ছিল, “আমি গণহত্যার বিরোধিতা করি, আমি ফিলিস্তিন অ্যাকশনের পক্ষে।” এই একই কারণে আরও অন্তত ৫২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার জামিন শুনানি আগামী অক্টোবরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। খবর আল জাজিরার।
পোরিট কোনো অপরাধী নন। তিনি তিন দশক ধরে রাজা চার্লসের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, যখন চার্লস প্রিন্স অব ওয়েলস ছিলেন। এছাড়া, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সময় গঠিত টেকসই উন্নয়ন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং সারা জীবন রাজনীতি, একাডেমিয়া ও পরিবেশবাদী সংস্থা ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ-এর মতো সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরিবেশ সুরক্ষায় অবদানের জন্য ২০০০ সালে তিনি সিবিই (কমান্ডার অব দ্যা অর্ডার অব দ্যা ব্রিটিশ এম্পায়ার) উপাধিতে ভূষিত হন।
আল জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পোরিট গাজা, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ব্যবসার ভূমিকা এবং অস্ত্রশিল্পের জলবায়ু প্রভাব নিয়ে কথা বলেন।
আল জাজিরা: গাজায় চলমান মানবিক সংকটের মধ্যে আপনি যুক্তরাজ্যকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। ৭০০-রও বেশি ব্যবসায়িক নেতার সঙ্গে যৌথভাবে আপনি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছেন। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় কি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও পড়বেন, যিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখোমুখি?
জনাথন পোরিট: অবশ্যই, তার মন্ত্রিসভার সদস্যরাও এই তালিকায় থাকা উচিত। কারণ তাদের বক্তব্যগুলো স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের অধিকারের লঙ্ঘন এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে। এখনই এই নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর করা প্রয়োজন এবং ব্যবসায়িক নেতাদের এ আহ্বান জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ ধরনের স্পষ্ট আগ্রাসন অব্যাহত থাকতে দেওয়া যায় না।
আল জাজিরা: অনেক মানুষ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে ইসরায়েলি পণ্যের বয়কটের ডাক দিয়েছেন। অর্থনীতিতে আঘাত করে সহিংসতা থামানোর এ প্রচেষ্টা কি কার্যকর?
পোরিট: আমি ব্যক্তিগতভাবে বয়কট করি। যুক্তরাজ্যে ইসরায়েল থেকে আমদানি করা কোনো পণ্য কিনতে আমার খুব অস্বস্তি হয়। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েল সরকারের কর্মকাণ্ড এতটাই জঘন্য যে আমি তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানকে কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারি না। তবে এটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, আমি কাউকেই বাধ্য করি না।
নৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তবে এগুলো বড় পরিবর্তন আনে কি না, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। অনেকে এসব ইস্যুর গভীরে গিয়ে বোঝার সুযোগই পান না।
আল জাজিরা: সম্প্রতি আপনার গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। রাজা চার্লস বা টনি ব্লেয়ার—যাদের সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন—তারা আপনার এই সরব প্রতিবাদের বিষয়ে কী ভাবতে পারেন বলে মনে করেন?
পোরিট: আমি একসময় মূলধারার ভূমিকায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি—যেমন ব্লেয়ার সরকারের কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়া বা প্রিন্স অব ওয়েলসের ব্যবসা ও টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি গড়ে তোলা। কিন্তু আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল কর্মী হিসেবেই—গ্রীন পার্টি ও ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থে। তাই তারা সবসময় জানতেন যে আমি আন্দোলনের পথের প্রতি বেশি আগ্রহী।
আল জাজিরা: বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধগুলোতে অস্ত্রশিল্প ও সামরিক খাতের ভূমিকা এবং তাদের জলবায়ু প্রভাব নিয়ে কি যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে?
পোরিট: একদমই না, আর এটি আমাকে ভীষণভাবে বিরক্ত করে।
নিউক্লিয়ার অস্ত্রের উন্নয়ন ও বাড়তি মজুদে বিপুল বিনিয়োগ চলছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। হিরোশিমা ট্র্যাজেডির ৮০ বছর পরও বিশ্ব আবারও ধ্বংসের পথে হাঁটছে—এটা অকল্পনীয়। এর সঙ্গে রয়েছে অস্ত্রশিল্পের বিপুল কার্বন নিঃসরণ, যা আমাদের গ্রহের জন্য সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে যে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে, সেটি আসলে সবচেয়ে ক্ষতিকর বিনিয়োগ।
আল জাজিরা: যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিন অ্যাকশনকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে, কিন্তু সংগঠনটির সমর্থকরা বলছেন, এটি গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দমনের কৌশল। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
পোরিট: ফিলিস্তিন অ্যাকশন মূলত সম্পত্তির বিরুদ্ধে প্রতীকী সহিংসতা ব্যবহার করে—বিশেষ করে সেসব অস্ত্র কোম্পানির বিরুদ্ধে যারা গাজায় গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তারা মনে করে, গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞের তুলনায় তাদের কৌশল সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত এবং নৈতিকভাবে প্রতিরক্ষাযোগ্য।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাজ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের অধিকার নিয়ে ভয়াবহ দমননীতি চালু হয়েছে। ফিলিস্তিন অ্যাকশনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হলো তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া।
এটি যুক্তরাজ্য সরকারের গাজায় গণহত্যায় স্পষ্ট সহযোগিতার প্রমাণ। কারণ সরকার জানে, গাজায় সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য ব্যবহৃত অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান অব্যাহত রাখা এক নৈতিক অপরাধ, আর এ সত্য ঢাকতেই এই দমননীতি চালু করা হয়েছে।