পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি, সতর্ক অবস্থানে ভারত

সম্প্রতি পাকিস্তান ও সৌদি আরব একটি আনুষ্ঠানিক পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, এই দুই দেশের মধ্যে যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে।
চুক্তির এমন ধারার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) জানিয়েছে যে, তারা এই চুক্তির বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা, পাশাপাশি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করবে। দেশটি জানায়, তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। খবর দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের।
দিল্লি আরও জানায়, ভারত সরকার ‘বিবেচনাধীনে থাকা’ এই চুক্তির বিষয়টি সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল। সূত্রগুলো জানিয়েছে, রিয়াদ ও রাওয়ালপিন্ডির মধ্যে এই প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়ে সৌদি পক্ষ ভারতকে ‘যোগাযোগের মধ্যে রেখেছিল’।
সূত্রগুলো আরও জানায়, সাবেক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের জন্য সৌদি আরব একটি অন্যতম প্রধান কর্মসংস্থান কেন্দ্র। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, ২০১৭ সালে সাবেক পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটের প্রধান কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ।
দিল্লির দৃষ্টিতে এই প্রতিরক্ষা চুক্তিকে এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে সরে আসা, কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণ এবং এর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার একটি জবাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণ—যা ইরান, লেবানন, সিরিয়া এবং কাতারসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ আক্রমণের শিকার হয়েছে, এবং যার ফলে পশ্চিম এশিয়ার অনেক দেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে, সৌদি-পাকিস্তান চুক্তিটিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত বুধবার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের উপস্থিতিতে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সি থেকে প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী, চুক্তিটিতে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘এই চুক্তির লক্ষ্য হলো উভয় দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো এবং যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’
এ প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘আমরা সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের খবর পেয়েছি। ভারত সরকার এ বিষয়টি নিয়ে তাদের অগ্রগতির বিষয়টি জানতো। এতে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের একটি ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রূপ দেওয়াটা বিবেচনাধীন ছিল।’
রণধীর আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর এর প্রভাব খতিয়ে দেখব। সরকার ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং সব ক্ষেত্রে সমন্বিত জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
যদিও সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা অংশীদারত্ব রয়েছে, তবে ভারত গত এক দশক ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি শক্তিশালী এবং দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ইয়েমেনে মিশরের যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগের কারণে পাকিস্তানের সৈন্যরা প্রথম সৌদি আরব গিয়েছিল। প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশের সহযোগিতা ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭৯ সালে মক্কায় গ্র্যান্ড মসজিদ দখলের পর তা আরও গভীর হয়, যখন পাকিস্তানের বিশেষ বাহিনী সৌদি সৈন্যদের পবিত্র মসজিদ আল-হারাম পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিল।
১৯৮২ সালে দুই পক্ষ একটি দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, যা সৌদি ভূখণ্ডে পাকিস্তানি প্রশিক্ষণ, উপদেষ্টা সহায়তা এবং সৈন্য মোতায়েনের সুযোগ করে দেয়। একসময়, প্রায় ২০,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য সৌদি আরবে অবস্থান করতো এবং সৌদি আরব পাকিস্তানের তৈরি অস্ত্রের একটি প্রধান ক্রেতা হয়ে ওঠে।
গত দুই দশকে ভারতের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে বাদশাহ আবদুল্লাহর ভারত সফরের পর থেকে এই সম্পর্ক সামনের দিকে এগিয়েছে এবং ২০১০ সালে ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও সৌদি আরব সফর করেন।
গত দশকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছেন। তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে রিয়াদ সফর করেন, এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ভারত সফর করেন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কও বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হলো ভারত, এবং ভারত হলো সৌদি আরবের পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪২.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ভারতের রপ্তানি ১১.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমদানি ৩১.৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবে ভারতীয় বিনিয়োগও বেড়েছে, যা ২০২৩ সালের আগস্টে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। পিআইএফ, অন্যান্য সৌদি কোম্পানি এবং সৌদি সমর্থিত ভিশন ফান্ডের মাধ্যমে ভারতে সৌদি বিনিয়োগ প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সৌদি আরবে প্রায় ২৭ লাখ ভারতীয় রয়েছে এবং সেখানে তাদের ভালো সুনাম রয়েছে।
সুতরাং, ভারত এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই শক্তিশালী ও গভীর অংশীদারত্বের সময়ে, রিয়াদ এবং ইসলামাবাদের মধ্যকার এই চুক্তিকে দিল্লি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
ভারত এই ঘটনাকে সতর্কতার সঙ্গে দেখছে, কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদার সৌদি আরব এবং পাকিস্তান। পাকিস্তানের বিষয়টি আলাদা কেননা ভারত পাহেলগাম হামলার জবাবে গত মে মাসে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে দেশটিতে হামলা চালিয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন সৌদি আরব সফরে ছিলেন, তখন পাহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছিল দেশটি। পরে, অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সফরের পর সৌদি আরবের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর অপ্রত্যাশিতভাবে ভারত সফর করেছিলেন।

অতীতে, সৌদি আরব জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিষয়ে খুব বেশি কঠোর সমালোচনা করেনি। এছাড়াও, তারা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছিল এবং বালাকোট হামলার নিন্দা জানায়নি। বরং, ২০১৯ সালে আল-জুবেইরকে ভারতে একজন দূত হিসেবে পাঠিয়েছিল। সংকট এবং সংঘাতের সময়ে সৌদিরা ভারত ও পাকিস্তানের উভয় নেতার সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করেছে এবং সাম্প্রতিক উত্তেজনাগুলোতে কোনো পক্ষ নেয়নি।
এই ধরনের আঞ্চলিক গতিশীল পরিস্থিতিতে পাকিস্তান এবং সৌদিদের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতা নিয়ে দিল্লি আলোচনা করবে রিয়াদের সঙ্গে। সূত্রগুলো জানিয়েছে যে এই বিষয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা হবে, কারণ দিল্লি সীমান্তে পাকিস্তানের সামরিক অবস্থানকে পুনরায় মূল্যায়ন করবে।