‘বাংলাদেশের সঙ্গে কীর্তনের নাড়ির টান রয়েছে’

ভারতের সংগীতশিল্পী সুমন ভট্টাচার্য। কলকাতায় তাঁকে বলা হয় কীর্তনসম্রাট। গান গাওয়ার পাশাপাশি ভারতের শান্তিনিকেতন স্কুলে শিক্ষকতা করছেন তিনি। শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও জনপ্রিয় সুমন ভট্টাচার্য। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে নিজের সংগীতজীবনের শুরুর গল্প ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
এনটিভি অনলাইন : কবে থেকে আপনার সংগীতচর্চা শুরু হয়?
সুমন ভট্টাচার্য : খুব ছোটবেলায় আমি সংগীতচর্চা শুরু করি। প্রথমে বাবার কাছ থেকে কীর্তন শিখেছিলাম। বড় হয়ে বাবা ছাড়া আরো সাতজন গুরুর কাছ থেকে আমি কীর্তন শিখেছি। কীর্তন শেখার সময় আমি উপলব্ধি করি এটা অনেক মূল্যবান সংগীত। আমি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেছি। এ ছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীত বিষয়টি নিয়েও আমি পড়াশোনা করেছি।
এনটিভি অনলাইন : শান্তিনিকেতনে আপনার শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা জানতে চাই...
সুমন ভট্টাচার্য : আমি এক বছর ধরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষা দিচ্ছি। এখানে স্টুডেন্টরা যন্ত্রসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে পড়াশোনা করেন। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর যাঁরা অনার্স ও মাস্টার্স করেন, তাঁদের কীর্তন বিষয়টিও পড়তে হয়। শান্তিনিকেতনের স্টুডেন্টরা কীর্তন নিয়ে অনেক উৎসাহী। ৫০ বছর আগের শান্তিনিকেতন আমি দেখিনি। ১০ বছর ধরে দেখছি। সত্যি বলতে, এখানকার ছেলেমেয়েরা অনেক পরিশ্রমী। সত্যিকারের সংগীত শিখতে তাঁরা এখানে আসেন। এখান থেকে বের হয়ে কেউ ভাগ্যবশত নাম করতে পারেন, আবার দুর্ভাগ্যবশত কেউ পারেন না।
এনটিভি অনলাইন : আপনার এখন পর্যন্ত কতগুলো গানের সিডি রয়েছে? কীর্তন গেয়ে কেমন সাড়া পান?
সুমন ভট্টাচার্য : ৫০টি। কলকাতা থেকেই সব সিডি বের হয়েছে। বাংলাদেশেও সিডিগুলো পাওয়া যায়। অনেক সিডি পাইরেসিও হয়েছে। অনেকেই এখন আমার কীর্তন বলার স্টাইল অনুসরণ করছেন। দেশের বাইরে থেকেও ফোন করে কেউ কেউ আমাকে বলেন, ‘দাদা, আপনার সিডি থেকে আমরা কীর্তন শিখেছি।’ পশ্চিমবঙ্গের সব জেলা ও গ্রামগঞ্জে কীর্তনের অনেক বড় বড় উৎসব হয় যে যেটা দূর থেকে কেউ চিন্তাও করতে পারবেন না। এক সপ্তাহ এবং এক মাস ধরেও পদাবলি সাহিত্যের কীর্তনের অনুষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অনেক জেলায়ও কীর্তন নিয়মিত হয়। আমার বাংলাদেশেও অনেক গুরু রয়েছেন। তাঁরা হলেন বৃন্দাবন বণিক, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, কংশবণিক প্রমুখ।
এনটিভি অনলাইন : ঢাকায় গেল জন্মাষ্টমীতে আপনি একটি অনুষ্ঠান করেছেন। কেমন লেগেছে?
সুমন ভট্টাচার্য : বাংলাদেশের সঙ্গে কীর্তনের নাড়ির টান রয়েছে। ঢাকায় এর আগে অনেকবার ঘুরতে এসেছি, কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান করা হয়নি। এবারই প্রথম জন্মাষ্টমীতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অনেক বড় একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। খুব ভালো ছিল সেই অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারমূলক অনুষ্ঠানেও আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : রবীন্দ্রনাথ ও কীর্তন নিয়ে আপনি তো গবেষণাও করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাই…
সুমন ভট্টাচার্য : রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন নাটকে কীর্তনের সুর ব্যবহার করেছেন। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ এই গানের পুরোপুরি সুর কীর্তনের। রবীন্দ্রনাথ কীর্তনকে সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কীর্তন এমন একটি সংগীত, যেখানে সাহিত্য ও সুর-তালের সমান মূল্য আছে।
শাস্ত্রীয় সংগীতে সুর ও তালের মূল্য অনেক বেশি। সেখানে সাহিত্য কম। কিন্তু কীর্তন গানের বাণী ও সুর দুটোকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথ কীর্তনকে বলেছেন অর্ধনারীস্বর। বাণী ও সুরের সমান মেলবন্ধনে সংগীত হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন, কীর্তন সংগীতে এটা রয়েছে। কীর্তন ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করে খুব ভালো লাগছে।
শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, কাজী নজরুল ইসলামও কীর্তন রচনা করেছিলেন। তাঁর দেওয়া কীতর্নের সুর ‘আমি কি সুখে লো গৃহে রব’ গানে রয়েছে। এই গান তিনি বিভোর হয়ে গাইতেনও।
এনটিভি অনলাইন : ২০১৬ সালে কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘সংগীত সম্মান পুরস্কার’ আপনি পেয়েছেন। কেমন লেগেছে?
সুমন ভট্টাচার্য : কীর্তনের জন্য এই পুরস্কার আমি পেয়েছি। এটা অবশ্যই আনন্দের বিষয়।
এনটিভি অনলাইন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।
সুমন ভট্টাচার্য : আজ পর্যন্ত যেসব কীর্তন অপ্রকাশিত রয়েছে, সেগুলো প্রকাশ করতে চাই। এরই মধ্যে আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি। কীর্তন নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করার ইচ্ছা রয়েছে। কলকাতায় কীর্তন শেখার জন্য আমি একটি স্কুল দিয়েছি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কীর্তনের প্রতি আগ্রহ দেখে আমি মুগ্ধ। খুব ভালোবেসে তাঁরা কীর্তন শিখছে।
যাহোক, ভবিষ্যতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার স্বপ্ন দেখছি। কীর্তন নিয়ে আমি একটা বইও লিখেছি। সামনে আরো বই লেখার ইচ্ছা আছে।