আমার কাছে বাংলাদেশ মানেই অ্যামেজিং : অরুণিমা

একসময় ছিলেন বিখ্যাত টেলিভিশন তারকা। মাঝে কিছুদিনের বিরতি নিয়ে ফের শুরু করেছেন দ্বিতীয় ইনিংস। এবারের ইনিংস চলচ্চিত্রে। আর এই ইনিংসের প্রথমেই এসে ছক্কা হাঁকিয়েছেন ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘ভাড়াটে’ আর ‘বঙ্কুবাবু’র মতো হিট ছবি দিয়ে।
যাঁর কথা বলা হচ্ছে তিনি টলিউড অভিনেত্রী অরুণিমা ঘোষ। বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে যার পরিবারের স্মৃতি। এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চাইতেই সেই অরুণিমা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন।
কথোপকথনের শুরুতেই অরুণিমা বললেন, ‘এই তো কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ওখানকার একটা ভিডিও শুট আর দুটো বিজ্ঞাপনের শুট হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে একটার কাজ হলেও আরেকটা কিছুটা পিছিয়েছে।
তাই মনে হচ্ছে পুজোর আগেই আরেকবার ঢুঁ মারব বাংলাদেশে।’
বাংলাদেশের খাবারের দারুণ প্রশংসা করলেন অরুণিমা। বললেন, ‘বাংলাদেশ মানেই আমার কাছে অ্যামেজিং, জানেন তো আমি খুব খেতে ভালোবাসি। আর আমার প্রিয় খাবার বিরিয়ানি। বাংলাদেশ মানেই ইলিশ মাছের বিরিয়ানি, ইলিশ ভাপা আর ফিরনি। বলতে পারেন আমার সব থেকে প্রিয় ডিশ।’
সুযোগ বুঝে বললাম, ‘তাহলে তো নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো স্মৃতি আছে বাংলাদেশকে নিয়ে?’
প্রশ্ন শেষ করার আগেই বলে উঠলেন, ‘অফকোর্স। দারুণ স্মৃতি। কিন্তু সেটা আমার অভিনয় রিলেটেড নয় কিন্তু। একেবারেই ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে বাংলাদেশকে ঘিরে।’
এবার অনুরোধের সুরে করলাম, ‘যদি সেই স্মৃতি বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য একটু শেয়ার করেন?’
অরুণিমা বললেন, ‘আমার পরিবার দেশভাগের সময় ভারতে চলে আসে। শুনেছিলাম আমরা খুলনায় থাকতাম। কিন্তু তখনো বাংলাদেশে যাওয়া হয়নি। আমি ১৫ বছর বয়েসে অভিনয় করতে আসি বাবা-মায়ের অমতেই। ফলে বাবা আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। একটা টিভি চ্যানেলে কাজ করতে করতেই বাংলাদেশের কক্সবাজারের একটা জায়গা থেকে জলসার শো করার অফার আসে। তখন আমার পাসপোর্টও ছিল না। বাবার সঙ্গে বাংলাদেশের সেই ট্যুর নিয়ে ভয়ে ভয়ে কথা বললাম। ব্যস, বাবা-মেয়ের মধ্যেকার রাগ ভ্যানিশ হয়ে গেল বাংলাদেশের জন্যই। (এবার হেসে ফেললেন) তারপর সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবার সঙ্গেই গেলাম বাংলাদেশ ট্যুরে। সেই আমার প্রথম বাংলাদেশ যাওয়া।
অবশ্য অনুষ্ঠানের জন্য গেলে যা হয়, বেড়ানো হয় না। তবুও তো সেই প্রথম বাংলাদেশ গেলাম। তাহলে বলুন বাংলাদেশ আমার কাছে স্পেশাল কি না?’
বললাম, ‘শুনেছি বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে গেলে আপনি নস্টালজিক হয়ে পড়েন?’
উত্তরে অরুণিমা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘একেবারেই তাই। বাংলাদেশে আমার অনেক বন্ধু আছে। তাদের সঙ্গে গল্প করার সময় জানতে পারি, আমাদের এখানে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে সবাইকে একই পরিবারের লোকের মতো মনে করে, ওখানেও তাই। আমি নিজে কাজ করতে গিয়েও দেখেছি। এটাই আমাকে কাজ করতে সাহায্য করে। আই ফিল কমফোরটেবল। বেশি মেকি হাসি, প্লাস্টিক অ্যাটিচুড আমি একদম পছন্দ করি না। বলতেই পারেন যে, আমি প্রফেশনাল নই।’
এবার বেশ ইতস্ততভাবে প্রশ্ন করি, ‘অনেকেই বলেন, আপনি নাকি অভিনয়ের ক্ষেত্রে একটু নাক উঁচু গোছের! যে কোনো চরিত্রে অভিনয় বা যে কোনো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে আপনি পছন্দ করেন না?’
উত্তরে অরুণিমা সাফ জানালেন, ‘এটা ঠিক কথা নয়, আপনারা তো জানেনই যে আমি মূলত টেলিভিশনে কাজ করতাম। তারপর প্রায় একযুগ ধরে অভিনয়জগতে আছি। এখন কিছুটা চুজি তো হতেই পারি। একটু বেছে কাজ করতে চাই। তাই বলে এই দোষ দিলে চলবে না (বলেই হেসে ফেললেন)।’
বললাম, ‘কাজ করতে করতে প্রায় তিন-চার বছরের একটা ব্রেক নিলেন। হঠাৎ এতদিনের জন্য সরে গেলেন কেন?’
হেসে বললেন, ‘আসলে টেলিভিশনের কাজ করতে করতে ক্লান্তি এসে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল ভিডিও শ্যুটের কাজ, বিজ্ঞাপনের কাজ। মনে এক ধরনের একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল। সেই সময় অনেকগুলো ছবির অফার এসেছিল। তখন সেই সব অফার ছেড়ে দিয়েছি। এবার টেলিভিশন ছাড়ার পর আর সেই মতো অফার আসছিল না। আমি এমনও বলেছিলাম যে, পারিশ্রমিক কম দিক, কিন্তু মনের মতো চরিত্র দিক। কাজ পাওয়া কমে গেল। একটা ডিপ্রেসন তো কাজ করেই।’
‘তো সেই সময় কী করলেন?’ জানতে চাই অরুণিমার কাছে।
প্রশ্ন শুনে আবারও হেসে উঠলেন অরুণিমা। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘সে সব সাংঘাতিক তথ্য। আপনাদের অনলাইনে বের হওয়ার পর হয়তো দেখবেন, আমার ফেসবুকে হাজার হাজার প্রশ্ন আসতে শুরু করেছে।’
তবুও অনুরোধ করতেই বললেন, ‘আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম মাত্র ১৫ বছর বয়সে। পরিবারের কোনো ইচ্ছা ছিল না। বাবা-মায়ের সঙ্গে একরকম ঝগড়া করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। আসলে আমি খানিকটা ক্রেজি।
খানিকটা অ্যারোগেন্টও। আট-দশ বছর টানা কাজ করার পর ওই যে বললাম ক্লান্ত লাগছিল। তাই ভাবলাম ইতালি ঘুরতে যাব। ইউরোপ ট্যুর করব। বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটাব। কিন্তু তারপর আর কিছুই করা হয়ে উঠল না।’
ডিপ্রেসনের কারণ জানতে চাইলে কোনো রাখঢাক না করেই বললেন, ‘কাজ থেকে, সবার থেকে একটু সরে থাকতে চাইলাম। বাবা-মা বললেন, বেড়াতে যাবি বললি, কি হলো? আমি মাসের পর মাস তিরুপতি বালাজি আর বেনারস গিয়ে বসে রইলাম। বহু মাস বাদে কলকাতায় ফিরলাম। পুরনো কিছু ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে তাদের সঙ্গে আড্ডা মারলাম। প্রচুর সিনেমা দেখলাম। সেই সময়ের নায়িকা সংবাদ ছবির অফারটা এলো। ব্যস, কাজ শুরু করে দিলাম।’
ফের মনে একটু দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘শুনেছি আপনি নাকি এখনো ইনসমনিয়ায় ভোগেন?’
উত্তরে অরুণিমা বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রায় সারা রাতই জাগি। রাত ২-৩টা অবধি তো অবশ্যই। ভোরের দিকে আবার ঘণ্টাখানেক ঘুমোই। তারপর তো জিমে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। অথবা শুট থাকলে চলে যাই।’
এবার প্রশ্ন করে বলি, ‘শিল্পীরা তো একটু-আধটু ইমোশনাল হয়, আপনার ক্ষেত্রে...’
প্রশ্ন শেষ করার আগেই অরুণিমা বললেন, ‘ধুর ইমোশনাল কী বলছেন, বলুন ইমোশনাল ফুল। আমি সত্যিই খুব বোকা। আসলে (একটু থেমে) আমার রিলেশনটা ভেঙে যাওয়ার পর আমার সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লেগেছে। আর একটা জিনিস সেই সময়ে উপলব্ধি করেছি যে, যতই মন খারাপ হোক না কেন, ওষুধ, ডাক্তার এসব কিছুই কাজ করে না। নিজের মনের জোরই শেষ কথা। আমি শুনেছিলাম, ঈশ্বর নাকি কাউকে বারবার সুযোগ দেন না।
আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, আমায় ঈশ্বর দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছেন। বহু ভালো কাজের অফার আসছে। আমি এখন খুব খুশি।’
পরের প্রশ্নে জানতে চাই, ‘টেলিভিশনে তো ফিরলেন একটি জমাটি শো-এর হোস্ট হয়ে। কিন্তু...’
উত্তরে অরুণিমা বললেন, ‘হ্যাঁ, স্টার জলসা চ্যানেলের রান্নাঘর এ হোস্ট হিসেবে জয়েন করেছিলাম। শো-টি খুবই ইউনিক ধরনের ছিল। তবে কোনো অজানা কারণে হয়তো আমাকে আর চ্যানেলের রাখতে ভালো লাগল না। তবে এখন তো প্রিয়াঙ্কা হোস্ট, খুব ভালো করছে।’
এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনো লবির কথা বলছেন?’
সঙ্গে সঙ্গেই অরুণিমার উত্তর, ‘দেখুন সেটা তো হয়ই। তবে আমার কোনো পার্সোনাল অ্যাসিটেন্ট বা পিএ নেই। দেখলেন তো, আপনিই কেমন নিজেই সরাসরি ফোন করলেন। আমি নিজের জন্য এজেন্ট রাখি না। যেভাবে কাজ আসে, তাতেই কাজ পাই। এতে আমার আলাদা করে কোনো ক্ষোভ নেই। আমি যেটুকু কাজ করেছি তাতেই আমি খুশি।’
আগামীতে কোন কোন ছবি আসছে জানতে চাইল এই অভিনেত্রী বলেন, ‘অতনু ঘোষের অ্যাবি সেন নামের একটি ছবিতে অভিনয় করছি।’
এবার সংক্ষেপে জানতে চাইলাম কয়েকটা বিষয় -
আপনার জন্মদিন?
অরুণিমা : ১৭ নভেম্বর।
প্রিয় খাবার?
অরুণিমা : চিকেন বিরিয়ানি, ইলিশ বিরিয়ানি।
শপিং করার প্রিয় জায়গা?
অরুণিমা : কলকাতা, ব্যাংকক আর শাড়ি হলে বাংলাদেশ।
প্রিয় পোশাক?
অরুণিমা : ক্যাজুয়াল হিসেবে জিনস-টি শার্ট, আর এমনিতে শাড়ি।
স্বপ্নের পুরুষ?
অরুণিমা : সৎ ও ভালো মনের মানুষ হতে হবে। তবে দেখতে কেমন সে নিয়ে মাথা ঘামাই না। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো থাকতে হবে।
সবশেষে বিদায় জানানোর আগে বাংলাদেশের পাঠকদের পক্ষ থেকে জানালাম অরুণিমাকে একরাশ শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।
হেসে অরুণিমা বললেন, ‘ওই যে বললাম না, ঈশ্বর কাউকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেন না। আমায় দিয়েছেন। সেটা পেয়েছি আপনাদের মতো মানুষের ভালোবাসা আছে বলেই। আমার পক্ষ থেকেও ভালোবাসা রইল বাংলাদেশের সবার জন্য। আর হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছি আপনাদের দেশে।’