সুরকে কি কাঁটাতারে আটকে রাখা যায় : গোলাম ফকির

‘আকাশটা কাঁপছিল ক্যান, জমিনটা নাচছিল ক্যান, বড় পীর ঘামছিল ক্যান - সেই দিন সেই দিন...’, ‘মনের মানুষ’ সিনেমার এই বিখ্যাত গানের মাধ্যমে দুই বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। তা ছাড়া তাঁর গাওয়া, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়/পারে লয়ে যাও আমায়...’ গানের মূর্ছনায় কাঁটাতারের সীমারেখাকে মুছে দিয়ে বাংলার আনাচে কানাচে যার অপার যাতায়াত, তিনি বাউলগানের এক নিষ্ঠাবান সাধক গোলাম ফকির। যার সাধক গুরু লালন সাঁই। তাই তো সময়-সুযোগ পেলেই ছুটে যান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায়, লালন সাঁইয়ের আখড়ায়।
সম্প্রতি কলকাতায় এসে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এক আড্ডায় মনের ডানা মেলে ধরেন গোলাম ফকির। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম গোরভাঙ্গায় বাড়ি তাঁর। যেখান থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব আধঘণ্টারও কম। সীমান্তের দুই ধারে একই রকম গাছ, একই রকম বাড়ি, একই রকম মানুষ, একই রকমের কথাবার্তা রোজই দেখছেন। তাহলে দুই দেশের মধ্যে কেন সীমান্ত! কেন এ-দেশ থেকে ও-দেশে যেতে গেলে লাগবে পাসপোর্ট! অবাক বিস্ময়ে সেই প্রশ্ন গোলাম ফকিরের চোখেমুখে।
২০০১ সাল পর্যন্ত নিজের কোনো পাসপোর্ট ছিল না তাঁর। পাসপোর্ট না থাকলে কেন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো যাবে না সেটাও জানতেন না তিনি। আজও বদ্ধমূল ধারণা তাঁর, গানের কোনো সীমান্ত হয় না। সুরের কোনো কাঁটাতার হয় না। মুর্শিদী, বাউল আর সেই সঙ্গে বস্তুবাদ, ভাববাদ আর বাউলতত্ত্ব নিয়েই কেটে যায় তাঁর দিন।
গান গাইতে গাইতে আজ বয়সের কোথায় এসে পৌঁছেছেন সে হিসাবও রাখেন না তিনি। ৫৫-৬০-৬৫ কিছু একটা বয়স হয়তো হবে। বয়স নিয়ে ভাবতেও চান না তিনি। তবে এই বয়সে এসেও গলায় সুর তুলে প্রশান্তির হাসি হাসেন গোলাম ফকির। কথায় কথায় গল্পের ছলে জানালেন, একবার সবার কথা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সীমান্তে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। সীমান্তে আসতেই উর্দিধারীরা পাসপোর্ট চাইলেন। ফকির জানিয়ে দেন, পাসপোর্ট তাঁর নেই। গুরুর আখড়া কুষ্টিয়ায় যেতে চান তিনি। কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া যেতে গেলে কী উপায়!
এরই মধ্যে ভারতীয় জওয়ানদের নজরে পড়ে ফকিরের কাঁধের ঝোলার ভেতর থেকে বন্দুকের মতো কী একটা উঁকি মারছে! শেষ পর্যন্ত হিন্দিভাষী জওয়ানদের বন্দুক আর দোতারার অর্থ বুঝিয়ে দেন গোলাম ফকির। কিন্তু তারপরও জওয়ানদের শর্ত, গান শোনাতে হবে। ব্যস, ভাবের ঘোরে পরপর পাঁচখানা গান শুনিয়ে দিলেন ফকির। তারপরই সীমান্ত পেরোনোর পাসপোর্ট মিলে গেল।
আজ ফকিরি তাঁর রক্তে। বাবা ফকিরি করতেন। ছোটবেলা পাটকাঠির ঘরে লালনের গান শুনে বড় হয়েছেন। বাউল গান, ফকিরি গানের নেশা ছিলো ভয়ংকরভাবে। দুই বেলা অন্ন না জুটলেও গান স্তব্ধ হয়নি গলা থেকে। তারপর একসময় বিয়ে করলেন। সংসারের তাড়নায় মজুরি করেছেন, গোরস্থানে কবর খোঁড়ার কাজও করেছেন। কবর খুঁড়তে খুঁড়তে সাধনার গান গাইতেন গোলাম ফকির।
ধর্ম নিয়ে আজ চারপাশে এত হানাহানি যার খবর কিছুটা হলেও রাখেন ফকির। বললেন, এসব রাজনীতির খেলা। পৃথিবীতে একটাই ধর্ম- মানবধর্ম। বিশ্বাস করেন, একমাত্র গান গেয়েই ওপরওয়ালাকে লাভ করা যায়। গানে গানেই বলা যায় একমাত্র শান্তির কথা। আজ ঈশ্বর-আল্লাহ-যিশুকে একই গানে স্মরণ করাই তাঁর সাধনা। সেই ২০০১ সালের পর আজ ২০১৫। এখন পাসপোর্ট হয়েছে গোলাম ফকিরের। প্রতিবছরই দেশ-বিদেশে যেতে হয়। তাই পাসপোর্ট। দুই বাংলার অবারিত মা-মাটি-মানুষের দিকে তাকিয়ে আজও যেন বিশ্বাস রাখতে পারেন না পাসপোর্টে। তাই তো অবলীলায় বলতে পারেন, ‘সুরকে কি আর কাঁটাতার দিয়ে আটকে রাখা যায় গো?’