মহৎ পেশার মানুষ
শিশুদের জন্য হাসপাতাল করতে চান ডা. হানিফ

শিশু কিডনি রোগের চিকিৎসায় তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বহু বছর ধরে। তাঁর প্রচেষ্টাতেই এ দেশের মানুষ জানতে পেরেছিল শিশুদের ওপর প্যারাসিটামলের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি। যার কথা বলছি, তিনি ডা. মো. হানিফ। বর্তমানে শিশু হাসপাতালের শিশু কিডনি বিভাগের প্রধান তিনি। এনটিভি অনলাইনের মহৎ পেশার মানুষ বিভাগে আজ থাকছে ডা. মো. হানিফের কথা।
বাবা চাইতেন ব্যবসায়ী হই
চিকিৎসক হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। উকিল হবো ভেবেছিলাম। বিভিন্ন সিনেমা দেখে প্রভাবিত হয়ে উকিল হতে চাইতাম। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। তবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার সময় ফ্লাইট মিস হওয়ার কারণে পরীক্ষা দিতে পারিনি।
আমাদের পুরো পরিবার ব্যবসায়ী। বাবা চাইতেন, আমি ব্যবসায়ী হই। তবে আমি কখনো আগ্রহ পেতাম না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একদিন তাঁর কাছে বসলাম। তিনি ভেবে বললেন, পেশায় যদি সৎ থাকতে চাও, ডাক্তারি ভালো। এখানে সৎ থাকা যায় এবং মানুষের সেবা করা যায়। পরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই।
আমার স্বাধীনতা ছিল অনেক। আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি, মা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। আমি চট্টগ্রাম শহরে থাকতাম। দুই ভাই ও পাঁচ বোন আমার। আমার মায়ের নাম আমেনা খাতুন। বাবার নাম জামাল হোসেন। মা লেখাপড়ার বিষয়ে বেশি খেয়াল করতেন। বাবাকে তাঁর আশপাশের লোকজন বোঝাতেন, ছেলে ভালো ফল করলে ব্যবসায় আসবে না। (হাসি)
আমি চট্টগ্রাম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছি। ১৯৭০ সালে ম্যাট্রিক পাস করি। আর ইন্টারমিডিয়েট পাস করি ১৯৭৩ সালে। এমবিবিএস পাস করি ১৯৭৯ সালে। এফসিপিএস ১৯৮৬-তে। কিডনি শিক্ষার ওপর উচ্চশিক্ষা ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নিই। অনারারি ফেলোশিপ করি রয়েল কলেজ অব এডিনবরা থেকে ২০০১ সালে।
আমি যখন মেডিকেল কলেজে ঢুকলাম, কিডনি বিভাগে আসার জন্য স্যার ডা. দেলোয়ার হোসেন উদ্বুদ্ধ করলেন। ওয়ার্ডে গিয়ে যখন চিকিৎসা করতাম, তখন খুব ভালো লাগত। ১৯৮২ সালে পিজি থেকে পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণ করি।
কিছুটা সচেতনতা আনতে পেরেছি
১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পিজিতে যখন এফসিপিএসের প্রশিক্ষণ করছি দেখছিলাম, কিছু রোগী কিডনি ফেইলিউর নিয়ে ভর্তি হচ্ছিল। তাঁদের ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়ার পর বাঁচানো যাচ্ছিল না। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল।
১৯৮৬ সালে শিশু হাসপাতালে যোগ দিই। এখানেও একই রকম অবস্থা ছিল। ১৯৮৮ সালে এখানে প্রথম ডায়ালাইসিস ওয়ার্ড শুরু করি। তখনো এ ধরনের রোগী ছিল। এরা চিকিৎসা দেওয়ার পরও মারা যাচ্ছিল।
একবার দেখলাম, সার্জারি ওয়ার্ডে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। সাধারণ চিকিৎসা করতে হাসপাতালে এসে কিডনি ফেইলিউর হয়ে মারা যাচ্ছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আমার তত্ত্বাবধানে কমিটি হয়। কমিটি অনেক পরীক্ষা করে দেখে, অনেক রোগী শুধু প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধ খায়নি। তখন প্যারাসিটামলের জন্য এমন হচ্ছে এ রকম ধারণা করে একটি দেশীয় কোম্পানির কাছে বিষয়টি যাচাই করতে দিই। তবে দেশে বিষয়টির তেমন কোনো সুরাহা করতে পারলাম না। এরপর বিদেশে ওষুধ পরীক্ষার জন্য পাঠালাম। বিভিন্ন গবেষণার পর ফল এলো। দেখা গেল, প্যারাসিটামলে ক্ষতিকর ডাই ইথাইলিন গ্লাইকোন পাওয়া গেছে। যেগুলো কারাখানায় ব্যবহার করা হয়। এগুলো দেহের জন্য ক্ষতিকর। আর এগুলো খেয়েই এ অবস্থা হচ্ছে। এই বিষয়গুলোতে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন ডা. রিয়াজ মোবারক ও ডা. দিলরুবা রহমান। সে সময় বিষয়টি নিয়ে লড়াই করতে আমাকে আরো সাহায্য করেছিল গণমাধ্যম।
১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর প্রেস কনফারেন্স করি। এরপর অবশ্য এই প্যারাসিটামল উৎপাদনের কোম্পানি এড ফ্লেইমকে শাস্তি দেওয়া হয়। একটি ড্রাগ ল অ্যামেনমেন্ট হয়। ব্যারিস্টার সারা ও তাঁর দল এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে কাজটি করে। এতে ওষুধের কিছু আইন প্রথমবারের মতো পরিবর্তন হয়।
আমাকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে এ বিষয়ে। তবে কিছুটা বোধ হয় সচেতনতা বাড়াতে পেরেছি। যে বিষয়টি নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছি, সেটি এখনো পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি। এই লড়াইগুলো আমার জীবনের ইতিহাস।
শিশুদের জন্য একটি কিডনি হাসপাতাল করতে চাই
আমার স্বপ্ন, একটি শিশু কিডনি হাসপাতাল তৈরি করার। যেখানে শিশুরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা নিতে পারবে। মানুষের জীবনে তো অনেক স্বপ্ন থাকে। জানি না এ স্বপ্ন পূরণ হবে কি না।
বর্তমানে বাচ্চাদের জন্য শিশু হাসপাতালে কিডনি আইসিও করা হয়েছে। এখানে আলাদা কিডনি রোগী দেখা হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য নজির। বিশ্বের কোনো দেশে এখন পর্যন্ত বাচ্চাদের জন্য কিডনি বিভাগে এমন আলাদা আইসিইউ নেই।
চেষ্টা করি সৎভাবে আয় করার
সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার পর যখন প্র্যাকটিস করতাম, দেখতে অনেক তরুণ লাগত। তখন রোগীরা রুমে এসে ফিরে যেত। ভাবত এ আবার অধ্যাপক হবে? এ রকম বহুবার হয়েছে। এটি আমার জীবনের খুব মজার ঘটনা।
আমি বেড়াতে পছন্দ করি খুব। প্রতিদিন প্রার্থনা করি যেন আমার মনে লোভ-লালসা না আসে। আমাকে দিয়ে যেন কারো ক্ষতি না হয়। উপকার করার যেন একটা প্রবণতা থাকে নিজের ভেতর সব সময়।
আমি চেষ্টা করি, সব সময় সৎভাবে আয় করার। অনেক সুযোগ এসেছে অসৎ হওয়ার। তবে অসৎ হইনি। আমি সৎ ও নিরহংকার থাকতে চাই। আমার স্ত্রী লোপা খান। তিনি পরিবেশবিদ। আমার দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে শামীম কায়সার। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর মেয়ে সুহি হানিফ, কানাডায় পড়াশোনা করছে।
পেশাকে নেশার মতো নিতে হবে
নতুনদের জন্য বলব, পেশাকে নেশার মতো নিতে হবে। না হলে ভালো করা যাবে না। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে হবে। তাহলে চিকিৎসা পেশার উন্নতি হবে, আমি সমাজের কোন অবস্থায় আছি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা কতটুকু। তাহলেই চিকিৎসক হিসেবে জীবনে পরিপূর্ণতা আসবে।