প্যানিক ডিজঅর্ডার কি পুরোপুরি ভালো হয়?

প্যানিক ডিজঅর্ডার একধরনের মানসিক রোগ। এই রোগে ব্যক্তি প্রচণ্ড রকম আতঙ্কের শিকার হন। আজ ২৭ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৮৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব।
প্রশ্ন : প্যানিক ডিসঅর্ডার কখন রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়?
উত্তর : প্যানিক ডিজঅর্ডার একটি রোগ আপনি শুরুতে বললেন। আমরা সাধারণত সব মানসিক রোগকে এক রোগ বলে বিবেচনা করি। আমরা বুঝতে পারি না মানসিক রোগের অনেক ধরন রয়েছে। শরীরের যেমন রোগ আছে, তেমনি মনেরও অনেক রোগ আছে। প্যানিক ডিজঅর্ডার হলো একধরনের রোগ। এখানে একটি প্যানিক অবস্থা তৈরি হয়। অনেক সময় এর কারণ আমরা জানি না। আবার অনেক সময় হয়তো কারণ থাকে, কোনো চাপজনিত কারণ থাকে। তবে হঠাৎ করে হতে পারে। দেখা গেল একজন মানুষ প্রতিদিনের কাজ করছেন, হঠাৎ করে বুক ধড়ফড় করা, দম বন্ধ হয়ে আসা মনে হয় যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, অথবা আমি মারা যাব, অথবা আমি মারা যাচ্ছি এ রকম একটা অবস্থা তৈরি হয়। একটি প্যানিক অবস্থা তৈরি হয়। এটি যদি একজন মানুষের মাসে অন্তত চারবার হয়, অথবা একবার হওয়ার পর যদি সব সময় মনে একটি ভয় থাকে, আবার যেন কোনো সময় হয় এবং আমি বোধহয় মরে যাব। আমি বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাব। তাহলেই সেটি প্যানিক ডিজঅর্ডার হয়। এখানে একটি কথা রয়েছে। অবশ্যই এই সমস্যাটি শারীরিক সমস্যার কারণে হচ্ছে না। যদি শারীরিক সমস্যার কারণে হয় তখন ওই নির্দিষ্ট রোগের দিকে চলে যাবে। যেমন : থাইরয়েড হরমোনের কারণে এটা হতে পারে বা অন্য কোনো কারণে হতে পারে। তাই আমাদের বুঝতে হবে যেই সমস্যাটি হচ্ছে সেটি থাইরয়েডের কারণে নয়।
প্রশ্ন : আসলেই মানসিক রোগ হিসেবে সমস্যাটি আসছে সেটি বোঝার উপায় কী?
উত্তর : এটা বিশেষজ্ঞরা বোঝেন। প্রথম কথা হচ্ছে যদি প্যানিক অ্যাটক হয় তখন কোনো না কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। যে কয়েকটি কারণে এই অ্যাটাক হতে পারে, সেগুলোকে বাদ দিতে হবে। এটা খুব বেশি কঠিন নয়। যাঁরা বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে তাঁরা জানেন।urgentPhoto
যেটা সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়, বুক ধড়ফড় করার কারণে একে অনেকে হার্টের রোগ মনে করেন। দুটো বিষয়ে এর পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করে। ভয় কাজ করে। একটি হলো আমার হয়তো হার্টের সমস্যা হয়েছে। আমি বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাব বা স্ট্রোক করব। আরেকটি হলো আমি হয়তো উচ্চ রক্তচাপের রোগী হয়ে গেলাম। এই দুটো বিষয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করে। হ্যাঁ যখন প্যানিক অ্যাটাক হয়, তখন সত্যি সত্যি উচ্চ রক্তচাপ অনেক বেশি থাকে। কিন্তু এই অনেক বেশি থাকা খুব বেশি ভয়ের কিছু নয়। আমরা যখন দৌড়াই বা খুব ভয়ের একটি কথা শুনি, তখন আমাদেরও রক্তচাপ মাপলে অনেক বেশি পাওয়া যাবে। তার মানে সেটি রোগ নয়। সেটিকে তখন উচ্চ রক্তচাপের রোগ বলা যাবে না। উচ্চ রক্তচাপের জন্য আলাদা কিছু বিষয় রয়েছে।
এ সময় অনেকে বলে এই যে তোমার এত বেশি উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ল। তুমি হয়তো উচ্চ রক্তচাপের রোগী। তবে বিষয়টি সেটি নয়। কেননা দৌড়ানোর পরও মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হতে পারে। তবে সেটি উচ্চ রক্তচাপের রোগ নয়। একই সময়ে প্যানিক অ্যাটাকের ক্ষেত্রেও এই জিনিস হয়, তখন মানুষ ভয়ের মধ্যে থাকে।
অনেক সময় এই ভয়টা মানুষের চলমান হয়। যে আবার কোনো সময় অবস্থাটি হয়। এই সঙ্গে তখন আরো একটি রোগ এসে জমাট হয়। এর নাম এগোরা ফোবিয়া। শব্দটা যদিও খোলা জায়গার ভয়। তবে আসলে দেখা যায়, প্যানিক অ্যাটাকের কারণে বাসে উঠতে পারে না। বেশি মানুষের কাছে যেতে পারে না। লিফটে উঠতে পারে না। এমনকি বাথরুমে গিয়েও দরজা আটকাতে পারে না। রোগী মনে করে, সেখানে আবার সেটা হতে পারে। মনে হয় আমি বুঝি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। এই জন্য একে প্যানিক ডিজঅর্ডার বলা হয়। এবং এই প্যানিক অবস্থাটি বারবার তখন হতে থাকে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা যোগ করতে চাই। এই সমস্যাটি কোনো অবস্থার সঙ্গে জড়িত নাও হতে পারে। যখন তখন হতে পারে। মানে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে হতে পারে।
প্রশ্ন : সমস্যাটি মাসে অন্তত চারবার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আপনি বললেন। আসলে কখন একজন রোগী আপনাদের কাছে আসবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : যখন একজন মানুষের এ রকম একটি-দুটি অ্যাটাক হলো, এরপর সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এবং ভয় লাগে। তখনই তার আসা উচিত। অন্তত যদি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নাও আসেন। তবে যে রোগের ধারণা উনি করেন, সেখানে যাওয়া উচিত।
তবে যখন কোনো রোগী কোনো একজন বিশেষজ্ঞের কাছে যান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, অনেক সময় তারা বলে দেন যে তোমার কোনো রোগ নেই। এটা নিয়ে একটু আপত্তি আছে। রোগ না থাকলে তো একজন মানুষ ভোগার কথা না।
ওই সময় সেই বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব হবে তিনি যে মানসিক রোগে আক্রান্ত সেটি একটু ধরিয়ে দেওয়া। এটি বলার মাধ্যমে চিকিৎসকের সততা যেমন প্রকাশ পায়। একইভাবে সে মানুষটিকে সাহায্য করতে পারে। তবে অনেক সময় বলে, আপনার কোনো রোগ নেই। আপনি চলে যান। এই বিষয়টি মানুষকে বিপদে ফেলে। বরং এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা যাতে কেউ না করেন।
প্রশ্ন : এই রোগে প্রাথমিকভাবে পরামর্শ এবং চিকিৎসা কী দিয়ে থাকেন?
উত্তর : নতুন একটি শব্দ এসেছে যাকে আমরা বলি সাইকো এডুকেশন। এখানে অনেক বড় একটি বিষয় থাকে, রোগটি যে এ রকম একটি রোগ, রোগীকে সেটা বোঝাতে হবে। পাশাপাশি রোগীর যারা পরিবারের লোকজন থাকে, অফিসে লোকজন যদি সম্ভব হয়, ওনাদেরও এই বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। যেমন : এই রোগের কারণে মৃত্যুর কোনো কারণ নেই। যদি আমরা চুপ করে থাকতে পারি। এবং অবস্থা যদি আওতায় থাকে আধাঘণ্টার মধ্যে এটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ বিষয়ে বেশ কিছু শিথিলকরণ প্রশিক্ষণ আছে। শিথিলকরণ ব্যায়াম শিখিয়ে দিতে হবে বা মেডিকেশনের একটি বিষয় রয়েছে। মেডিকেশন যেটা করে, রোগটি বারবার হওয়ার বিষয়টিকে কমিয়ে দেয়। এটার মারাত্মক বিষয়টিকেও কমিয়ে দেয়।
পাশাপাশি সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং যেটা সেটাও করানো যেতে পারে। অসুস্থ হওয়ার কারণে তার দৈনন্দিন কার্যক্রম যেন বন্ধ না হয়। আসলে সম্পূর্ণ বিষয়টি যদি ভালোভাবে চিকিৎসা করা যায়, এই রোগীরা খুব ভালো থাকেন।
তবে মজার বিষয় এবং ভয়েরও বিষয় আছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে শুনি, এই ভয়ের কারণে অনেকে তার সম্পদ আত্মীয়স্বজনকে একদম ভাগ করে দেয়। আমার বোধ হয় মৃত্যু হচ্ছে। আমি এ রকম একজন সার্জনকে জানি, যিনি ভয়ের কারণে ওনার সম্পদ সবকিছু ভাগ করে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সেই সময় উনি চিকিৎসা নেননি বলে। তবে যখন চিকিৎসা করালেন, তারপর তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।
প্রশ্ন : চিকিৎসা নেওয়ার কতদিন পরে রোগী বুঝতে পারে সে ভালো বোধ করছে?
উত্তর : এটা রোগীভেদে নির্ভর করে। তবে যদি নিশ্চিত করা যায় এই সমস্যাটি শারীরিক রোগের কারণে নয়, এই চিকিৎসা এভাবে করলে ভালো হয়। নিশ্চিত করার কয়েকদিনের মধ্যে তিনি আশ্বস্ত হন।
প্রশ্ন : কতদিন ধরে এই চিকিৎসা চলতে থাকে? পরে কি আবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে?
উত্তর : এটা একটা ভালো প্রশ্ন। অনেক সময় এই সমস্যায় আমাদেরও পড়তে হয়। একাডেমিক জায়গা থেকে বলা হয়, লক্ষণমুক্ত হওয়ার পরও অন্তত দুই বছর এটা থাকে। তবে অনেক সময় একটু লক্ষণ কমে গেলে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। বিশেষ করে অনেকে পরামর্শ দেয়, ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তখন হয়তো রোগী ওষুধ ছেড়ে দেয়। দেখা যায়, ওষুধ ছাড়ার কিছুদিন পরই রোগটি শুরু হয়। এখন কথা হচ্ছে সঠিক চিকিৎসা নিলেও কি আবার রোগ হতে পারে না? তাও হতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা নিলে হবে কি অন্তত ওই সময়টা ভালো থাকবে। এবং পরবর্তীকালে কীভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবেন সেটি বুঝতে পারবেন।
তবে আবার হতে পারে। সাধারণত প্যানিক ডিজঅর্ডার পারিবারিক একটি বিষয়ের কারণে হয়। যাদের পরিবারে উদ্বেগ বেশি থাকে, তাদের এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। রোগটি আবার পাঁচ বছর, ১০ বছর পরে হতে পারে। তবে বিষয়টি যদি তিনি ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে খুব দ্রুত সমাধান আসবে।
প্রশ্ন : এই সমস্যায় জটিলতা কী হতে পারে?
উত্তর : এর কারণে মানুষ মারা যাবে বিষয়টি সে রকম নয়। এ কারণে দৈনন্দিন সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এটিকে মাথায় রেখে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে হবে।