প্রবীণদের যত্নে কী করবেন

জীবনসায়াহ্নের গোধূলিবেলায় আসে বার্ধক্য। মানবজীবনের শেষ অধ্যায় এটি, মানবজীবনের নিয়তিও এটি। একসময় যারা নবীন ছিল, তারাই আজকে প্রবীণ। একসময়ে তারা নবীন ছিল, সবকিছু ছিল, পরিবারের জন্য কষ্ট করেছে, ছেলেমেয়ের জন্য পরিশ্রম করেছে। একটি পর্যায়ে আর আগের মতো কষ্ট তারা করতে পারে না। বার্ধক্য যখন আসে তখন কিছু শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শরীর তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গিয়ে দেহে রোগ জীবাণু বাসা বাঁধে।
একজন ব্যক্তি যখন বার্ধক্যে পা দেয়, তখন তার নিজের মধ্যেই কিছু বিষয় দানা বাঁধে। শারীরিকভাবে অসমর্থ, পরনির্ভরশীলতা, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, অসহায়ত্ব- এগুলোর কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে সে নিজেকে পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করে। অনেক প্রবীণই এ সময় এমন শিশুসুলভ আচরণ করেন; যা হয়তো পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।
পারিবারিকভাবে অনেক সময় প্রবীণরা অবহেলার শিকার হয়ে পরিবার থেকে দূরে সরে যায় বা পরিবারই তাকে ঠেলে দেয় দূরে। তার কাছের লোকেরা এমনকি ছেলেমেয়েরাও তাকে বোঝা মনে করে। আবার অনেক প্রবীণ নিজেই কারো ওপর বোঝা হয়ে থাকতে না চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়।
একসময় এই প্রবীণরাই হয়তো টাকা-পয়সা, ভালোবাসা দিয়ে যে সন্তানকে তৈরি করেছে, সেই সন্তানই হয়তো মা-বাবাকে বোঝা মনে করছে। বৃদ্ধাশ্রমে যখন তারা যায়, তখন আরো অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে সেখানে থাকে, চিকিৎসা হয়তো ভালোই হয়, কিন্তু পায় না পরিবারের লোকেদের সংস্পর্শ।
এই বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে যতই সেবা-যত্ন হোক না কেন, সে চায় পরিবারের লোকেদের সান্নিধ্য। অনেক সময় দেখা যায়, পূজা পার্বণ, ঈদ বা বিশেষ দিনেও হয়তো তার সঙ্গে সন্তান দেখা করতে যায় না। তখন তাদের দুঃখটা আরো বেড়ে যায়।
যারা আজ নবীন, তারাই একদিন প্রবীণ হবে এবং এই নিয়তি তাদের জন্যও আসবে এটি ভেবে আমাদের প্রবীণ বাবা-মায়ের প্রতি যত্ন নেওয়া জরুরি। তাদের অধিকার রয়েছে আমাদের ভালোবাসা পাওয়ার।
পারিবারিকভাবে যত্ন
- বৃদ্ধ হলে একজন মানুষের মানসিক-শারীরিক অনেক পরিবর্তন আসে। তখন তাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তার আচরণে হয়তো পছন্দ মতো নাও হতে পারে, তবুও তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা উচিত নয়।
- এই সময় বৃদ্ধদের ডিমেনসিয়া বা স্মৃতিভ্রম রোগ হয়। তখন সে অনেক কিছুই ঠিকমতো মনে রাখতে পারে না। এ সময় উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অস্টিওপোরোসিস, চোখের ক্যাটারেক্ট, পুরুষদের প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া, কিডনিতে ও লিভারে সমস্যা হয়। শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে এ সময় মানুষ খুব সহজে জীবাণুর মাধ্যমে আক্রান্ত হয়। সুতরাং এই বিষয়গুলোর ওপর খেয়াল রেখে তার যত্ন নিতে হবে।
- প্রয়োজনে পরিবারের লোকজনদের তাকে নিয়মিত চিকিৎসকের চেকআপে রাখতে হবে। চিকিৎসক যে চিকিৎসা দেবে সে অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াতে হবে। এই সময় প্রবীণ বাবা বা মা হয়তো ওষুধ মনে রাখতে পারে না। তাই তাকে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
- তাকে মাঝে মাঝে বেড়াতে নিতে হবে। পাশাপাশি তার জন্য বিনোদনমূলক ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে তার প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
সরকারি ও সামাজিকভাবে
- অনেক লোক হয় তো একসময় হয়তো নামকরা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধ হয়ে গেছে বলে তাকে বিভিন্ন সামজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া, মিটিং ইত্যাদিতে আমন্ত্রণ করা হয় না। এর ফলে সে নিজেকে আরো বেশি অসহায় এবং অবাঞ্চিত মনে করে। তাই সামাজিক বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে হবে। যেন সে নিজেকে উপেক্ষিত মনে না করে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ওয়াজ মাহফিল এসব অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
- সরকারিভাবে তাদের বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে এখনো প্রবীণদের জন্য কোনো বিভাগ নেই। হাসপাতালগুলোতে সরকারিভাবে জেরিয়াটিক বিভাগ চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিছানার ব্যবস্থা করা উচিত।
- সরকারিভাবে তাদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তার জন্য ভালো পরিমাণ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারিভাবে ভাতা দেওয়ার কিছু ব্যবস্থা থাকলেও সেটা অনেক সময় পর্যাপ্ত হয় না। ভালো পরিমাণ টাকা সে পেলে হয়তো তার মধ্যে নির্ভরশীলতার ভাব কমে যাবে। সে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ভাবতে পারবে।
- যারা শহরে থাকে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা জরুরি। তাদের জন্য ব্যাংকে বিশেষ বুথ বা আলাদা বিভাগ করা যেতে পারে। বাসে বা বিভিন্ন যানবাহনে আলাদা বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিদ্যুতের বিল, পানির বিল, গ্যাসের বিল- এসব ক্ষেত্রে আলাদা লাইনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বাসে, ট্রেনে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সম্ভব হলে তার ভাড়া কমিয়ে বিশেষ ভাড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
- বৃদ্ধাশ্রম যেগুলো বেসরকারি সেগুলোকে সরকারিভাবে সাহায্য দিয়ে আরো উন্নত করতে হবে। এবং সরকারিভাবে আরো বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা হয়।
- বৃদ্ধদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন হলো তার পরিবার। সরকারিভাবে এই বিষয় আরো মনোযোগ দিতে হবে। আইন করে এবং তার সঠিক প্রয়োগ করে এটা করা যেতে পারে।
- গ্রামে আর শহরে বৃদ্ধদের মধ্যে পার্থক্য থাকে। শহরে হয়তো অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকে, চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে কিন্তু গ্রামে থাকে না। সেখানে হয়তো ভালো হাসপাতাল নেই, ওষুধ নেই। তাই স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা হয়তো বিশেষ সুবিধা পায় না। তাই সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
আজকে যারা নবীন, তারাই একসময় প্রবীণ হবে। আমরা যদি দায়িত্বে অবহেলা করি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে আমরা বঞ্চিত হব এবং একই ধরনের আচরণ পাব। তাই পারিবারিক, সরকারি এবং বেসরকারিভাবে প্রবীণদের প্রতি আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, ডিন, মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ