ট্রাম্পের শুল্কারোপে যুক্তরাষ্ট্রে দাম বাড়তে পারে যেসব নিত্যপণ্যের

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বঘোষিত ‘লিবারেশন ডে’ পার হয়ে গেছে ঠিকই, তবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের মুদি দোকানের ক্রেতাদের মানিব্যাগে শিগগিরই নতুন করে ‘পারস্পরিক শুল্কারোপের’ প্রভাব পড়া শুরু হতে পারে। খাদ্য শিল্প বিশ্লেষক ফিল লেম্পার্ট সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে বলেন, ‘সম্ভবত একটি সুপারমার্কেটের প্রায় অর্ধেক পণ্য এই শুল্কের দ্বারা প্রভাবিত হবে, সেটি সম্পূর্ণরূপে হোক বা কেবল একটি উপাদানে।’
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপের লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠানোর ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
চলতি বছরের শুরুতে ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে ২০ শতাংশ এবং মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানকৃত পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেন। এরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে এই পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন তিনি।
মুদ্রাস্ফীতি ও শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে, তাই মুদি পণ্যের ক্রেতাদের ভবিষ্যতে কেনাকাটায় আরও সতর্ক থাকতে হতে পারে। ট্রাম্পের আরোপিত পারস্পরিক শুল্কের কারণে কিছু যেসব মুদি পণ্যের দাম বাড়তে পারে—
অ্যাভোকাডো এবং অন্যান্য ফলে কী প্রভাব পড়তে পারে?
ফলের দামের ওপর ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কের প্রভাব মিশ্র হতে পারে, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলের দাম প্রভাবিত হতে পারে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকো থেকে নেওয়া অন্যান্য ফল রক্ষা পাবে।
মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্যমতে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৫১ শতাংশ তাজা ফল মেক্সিকো থেকে এবং ২ শতাংশ কানাডা থেকে আমদানি করেছিল। হোয়াইট হাউস ও ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কের মুখে পড়া দেশগুলোর তালিকায় মেক্সিকো ও কানাডা নেই।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ফল আমদানি করে গুয়াতেমালা, কোস্টারিকা ও পেরু থেকে। তিনটি দেশই হোয়াইট হাউসের তালিকায় রয়েছে এবং তাদের ওপর ১০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও কৃষি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, গুয়াতেমালা, ইকুয়েডর, কোস্টারিকা, কলম্বিয়া ও হন্ডুরাস হলো যুক্তরাষ্ট্রে কলার প্রধান রপ্তানিকারক। ইউএসডিএ জানিয়েছে, গুয়াতেমালা যুক্তরাষ্ট্রে তরমুজ, কলা ও পেঁপে রপ্তানি করে এবং কোস্টারিকা আনারস, অ্যাভোকাডো ও আম রপ্তানি করে।
খাদ্য শিল্প বিশ্লেষক লেম্পার্ট এনপিআরকে বলেন, ‘এই পণ্যগুলো বেশি দিন থাকে না এবং শুল্ক বাড়ায় আমরা দাম ও সহজলভ্যতা উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সমস্যার মুখোমুখি হব।’
কিছু ফলের দাম বাড়তে পারে, তবে অ্যাভোকাডোর হয়তো বাড়বে না। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র অ্যাভোকাডো মেক্সিকো থেকে শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করতে পারে। ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মার্কিন কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র যে তাজা অ্যাভোকাডো আমদানি করে, তার ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ আসে মেক্সিকো থেকে।
সবজির দাম কি বাড়বে?
ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে আমেরিকার তাজা সবজির প্রায় ৬৯ শতাংশ মেক্সিকো এবং ২০ শতাংশ কানাডা থেকে এসেছিল।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১২৫টিরও বেশি দেশ থেকে তাজা শাকসবজি আমদানি করে, তবে বেশিরভাগ আসে মেক্সিকো ও কানাডা থেকে’, জানায় ইউএসডিএ।
সরকারি সংস্থাটির তথ্যমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাজা সবজি আমদানির পরিমাণ প্রায় ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং তাজা সবজির আমদানির মূল্য রপ্তানির চেয়ে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়, যা এক দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
যদিও মেক্সিকো ও কানাডার শাকসবজি পারস্পরিক শুল্কে প্রভাবিত না-ও হতে পারে, তবে হোয়াইট হাউসের তালিকায় থাকা গুয়াতেমালা, কোস্টারিকা, পেরু, ইকুয়েডর, চিলি, হন্ডুরাস, মরক্কো ও চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা শাকসবজির দাম বৃদ্ধি পেতে পারে।
সামুদ্রিক খাবারের (সি ফুড) দাম আরও বাড়তে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক ও অ্যাটমোসফেয়ারিক প্রশাসনের তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সামুদ্রিক খাবারের ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে মাছ ও শেলফিশ সরবরাহকারী বেশ কয়েকটি দেশের ওপর শুল্কারোপ করা হয়েছে, তাই সামুদ্রিক খাবার সম্ভবত ভবিষ্যতে আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে সামুদ্রিক খাবারের বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হলো চিলি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম। চারটি দেশই হোয়াইট হাউসের তালিকায় রয়েছে, তবে ভিয়েতনামে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আর চিলিতে ১০ শতাংশ, ভারতে ২৬ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ায় ৩২ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
দ্য ফুড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের কর, বাণিজ্য, স্থায়িত্ব ও নীতি বিষয়ক বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি হ্যারিগ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক খাবারের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আমদানি করা হয়, তাই মার্কিন শিল্পগোষ্ঠীর পক্ষে এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। স্বাভাবিকভাবেই সামুদ্রিক খাবারের দাম বেড়ে যাবে।
কফি কেনা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে
ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম কফি আমদানিকারক দেশ। সংস্থাটি জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কফি আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে লাতিন আমেরিকা থেকে, যার ৬০ শতাংশের বেশি আসে মাত্র দুটি দেশ ব্রাজিল ও কলম্বিয়া থেকে।
ব্রাজিল ও কলম্বিয়া উভয়েই হোয়াইট হাউসের তালিকায় রয়েছে এবং দেশ দুটির ওপর ১০ শতাংশ করে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ বিয়ার মেক্সিকো ও কানাডা, নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ড থেকে আমদানি করে। এর মধ্যে নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ডের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বিশ্লেষক লেম্পার্ট বলেন, চীন এবং অন্যান্য অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারী দেশের ওপর শুল্ক আরোপের কারণে ক্যানে বিক্রি হওয়া বিয়ারের দাম বাড়তে পারে দ্বিগুণ।
অলিভ ওয়েলের দাম হতে পারে আকাশচুম্বী
যুক্তরাষ্ট্রের অলিভ ওয়েল আমদানির শীর্ষ স্থানীয় উৎস হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষ করে স্পেন, ইতালি ও গ্রীস। ল্যাম্পার্ট বলেন, ‘অলিভ ওয়েলের দাম ইতোমধ্যে আকাশছোঁয়া। তারা দাম আরও বাড়বে।’
এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষ করে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানি করা কিছু পনিরের দাম বাড়তে পারে।

যেসব মুদি পণ্যের দাম না-ও বাড়তে পারে
যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়ার কারণে কিছু নিত্যপণ্যের দাম খুব বেশি না-ও বাড়তে পারে, তার মধ্যে রয়েছে গরুর মাংস ও ভাত। এই দুটি পণ্যের দাম বেশি না বাড়লেও কিছুটা বাড়তে পারে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার গরুর মাংসের ৯০ শতাংশ দেশীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, তবুও বিদ্যমান মূল্যের সঙ্গে শুল্ক যোগ হওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে। ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে, ১৯৫১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গবাদি পশুর সংখ্যা এখন সবচেয়ে কম।
গরুর মাংসের মতোই যুক্তরাষ্ট্রে প্রয়োজনীয় চাল দেশীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, তবে প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমদানি করা হয়। ইউএসডিএ জানিয়েছে, মূলত থাইল্যান্ডের জুঁই চাল ও ভারতের বাসমতি চাল আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। থাইল্যান্ড ও ভারত উভয় দেশই হোয়াইট হাউসের পারস্পরিক শুল্কের তালিকায় রয়েছে।