হিমঘরে সংরক্ষিত প্রবাল, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ রক্ষায় আশার আলো

সিডনির তারোঙ্গা চিড়িয়াখানার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোতে সারি সারি তরল নাইট্রোজেনে ভর্তি ট্যাংকে সংরক্ষিত রয়েছে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের বৈচিত্র্যময় প্রবাল। বিজ্ঞানীরা এই প্রবাল-সংগ্রহশালাকে বিলুপ্তির পথে থাকা বাস্তুতন্ত্রের জন্য এক ধরনের ‘বরফে মোড়ানো নৌকা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেন সময়কে থামিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রতি বছর ‘মাস স্পনিং’ মৌসুমে প্রবালের বিস্তৃত প্রজাতির লাখো কোটি কোষ সংগ্রহ করা হয়। এই সংগৃহীত কোষগুলোই ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিলুপ্তপ্রায় প্রবাল পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখছে।
তারোঙ্গা কনজারভেশন সোসাইটি অস্ট্রেলিয়ার সংরক্ষণবিষয়ক বিজ্ঞান ব্যবস্থাপক জাস্টিন ও’ব্রায়েন বলেন, ‘মূলত, এই প্রবালগুলোর জৈবিক ঘড়িতে আমরা বিরতি বোতাম চেপে দিয়েছি।’ এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা রিফের অপূর্ব বৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রবাল সংরক্ষণের পদ্ধতি ও চ্যালেঞ্জ
২০১১ সালে শুরু হওয়া এই প্রবাল সংরক্ষণ কর্মসূচির আওতায় প্রতি বছর গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে প্রজনন মৌসুমে ডিম ও শুক্রাণু ছড়ানোর সময় সেগুলো সংগ্রহ করে তারোঙ্গার ‘ক্রায়োডাইভার্সিটি ব্যাংক’। বিজ্ঞানীরা শুক্রাণু সংগ্রহ করে ‘ক্রায়োপ্রোটেকট্যান্ট’ নামের বিশেষ পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে তা হিমায়িত করেন, যা কোষের পানি সরিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ গঠন রক্ষা করে।
তবে ডিমে অতিরিক্ত পানি ও চর্বি থাকায় বর্তমান প্রযুক্তিতে হিমায়িত করলে সেগুলোর ক্ষতি হয়ে যায়। তাই এখন ওইভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবুও গবেষণার উদ্দেশ্যে অন্যান্য কোষ সংগ্রহ করে হিমায়িত করা হচ্ছে। এই নমুনাগুলো মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে রাখা হচ্ছে, যেখানে তাপমাত্রা কখনও পরিবর্তিত হয় না। ও’ব্রায়েন আরও বলেন, ‘আমরা এগুলো অনির্দিষ্টকাল ধরে জীবিত রাখতে পারি। বছরের পর বছর, এমনকি শতাব্দী পরেও এগুলো গলিয়ে ব্যবহার করা যাবে, ঠিক যেভাবে সংরক্ষণের সময় সেগুলো ছিল।’
প্রবালের বিলুপ্তি ও বৈশ্বিক হুমকি
এই ক্রায়োব্যাংকে এখন পর্যন্ত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রায় ৪শ প্রজাতির প্রবালের মধ্যে ৩৪টি প্রজাতি সংরক্ষিত রয়েছে, বিশেষ করে যেগুলো রিফের কাঠামো ও কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রজননের পাশাপাশি, এই নমুনাগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং দূষণের মতো বৈশ্বিক হুমকির প্রভাবে প্রবালের উপর প্রভাব পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়, তাহলে বিশ্বের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এমন হলে সমুদ্র ও মানবজীবনের জন্য চরম বিপর্যয় বয়ে আনবে।
প্রবাল প্রাচীর শুধু সামুদ্রিক প্রাণীকুলের আবাসস্থলই নয়, উপকূলবর্তী লাখ লাখ মানুষের জীবিকা, খাদ্য, ঝড়ের আঘাত থেকে সুরক্ষা ও পর্যটন শিল্প।
প্রবাল ধ্বংস ও বর্ণহীনতা : এক বৈশ্বিক সমস্যা
সমুদ্রের উষ্ণতা বেড়ে গেলে প্রবাল তাদের মধ্যে বাস করা শৈবাল ত্যাগ করে, যা তাদের রঙ ও খাদ্যের উৎস। এতে প্রবাল সাদা হয়ে যায় বা ‘ব্লিচড’ হয় এবং পরে রোগাক্রান্ত হয়ে খাদ্যাভাবে মরে যায়। ২০২৩ সাল থেকে বৈশ্বিক প্রবাল সাদা হওয়ার ঘটনা ইতোমধ্যে বিশ্বের ৮৪ শতাংশ প্রবাল প্রাচীরে ছড়িয়ে পড়েছে প্রশান্ত, ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরজুড়ে।
‘আন্তর্জাতিক প্রবাল প্রাচীর উদ্যোগ’ নামের একটি বৈশ্বিক সংরক্ষণ সংগঠন জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে ১৯৫০ এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত জীবন্ত প্রবালের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
আগামী সপ্তাহে ফ্রান্সে জাতিসংঘের একটি মহাসমুদ্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে দেশের নেতাদের কাছ থেকে সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ ও অর্থ সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানানো হবে। তবে গভীর সমুদ্রে খনন, প্লাস্টিক বর্জ্য ও অতিরিক্ত মাছ ধরা নিয়ে মতবিরোধ থাকায় ঐকমত্য ও অর্থ সংগ্রহ কঠিন হতে পারে।
আশার আলো
ও’ব্রায়েন বলেন, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও স্থিতিশীলতা দেখিয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে ক্ষতির মাত্রা ও ঘনত্ব বাড়ছে, তা থেকে পুনরুদ্ধার করার সময় প্রবাল প্রাচীর পাচ্ছে না। তবে বিশ্বে গুটিকয়েক ক্রায়োব্যাংকের মধ্যে তারোঙ্গার ব্যাংক আশার আলো দেখাচ্ছে।
গত বছর তারোঙ্গা ও অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা হিমায়িত প্রবালের শুক্রাণু গলিয়ে তাজা ডিম নিষিক্ত করে সফলভাবে প্রবাল লার্ভা উৎপাদন করেন এবং তা রিফে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের জন্য বিশ্বে প্রথম ঘটনা।
প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিস্থাপিত প্রবাল ভালোভাবে বেড়ে উঠছে। এই উদ্যোগ বৃহত্তর এক পরিকল্পনার অংশ, যার মধ্যে প্রবালকে ছায়ায় রাখা থেকে শুরু করে তাপ সহনশীল প্রজাতি প্রতিস্থাপন পর্যন্ত বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে।
তবে ডব্লিউডব্লিউএফ অস্ট্রেলিয়ার মহাসাগর বিষয়ক প্রধান রিচার্ড লেক সতর্ক করে বলেন, ‘এই পদক্ষেপগুলো বড় সমস্যার ছোট উদ্যোগ মাত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রবালকে টিকিয়ে রাখার সুযোগ এখনো রয়েছে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম।’