আধুনিকতায় ঢাকা পড়ছে বাংলার কৃষি ঐতিহ্য

কাকডাকা ভোরে গরুর গলায় ঘণ্টার আওয়াজ, কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে জমির দিকে হেঁটে যাওয়া কৃষকের দৃশ্য এক সময় ছিল বাংলার পল্লীজীবনের চিরচেনা রূপ। গরু দিয়ে হালচাষ শুধু একটি চাষাবাদ পদ্ধতি নয়, এটি ছিল গ্রামীণ কৃষকের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যের প্রতি গভীর মমতার সেসব দিন এখন কেবলই স্মৃতি। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির সাদামাটা কৃষি সংস্কৃতি।
লালমনিরহাটসহ দেশের কৃষিনির্ভর এলাকায় একসময় গরু দিয়ে জমি চাষ ছিল প্রতিটি কৃষকের নিত্যদিনের সঙ্গী। ঘরে দুটি গরু থাকাটা ছিল গর্বের বিষয়। অনেক কৃষক নিজেদের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতেও হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সেই দৃশ্যপট। এখন কৃষকরা সময় ও খরচ বাঁচাতে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার ব্যবহার করছেন। গরু দিয়ে হালচাষ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাধ্য হওয়ায় কৃষকরা এর প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি।
তবে মাঝেমধ্যে দেখা মেলে পুরোনো দিনের কোনো দৃশ্য। সম্প্রতি লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর এলাকায় দেখা গেছে গরু দিয়ে হালচাষের এমন একটি চিত্র। কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, ‘অনেক দিন পর আমরা দুজন মিলে মাঠে গরু দিয়ে মই ও হাল দিচ্ছি। ভালোই লাগছে। আগে গরু ছাড়া চাষাবাদ কল্পনাই করা যেত না। এখন যন্ত্রে কাজ দ্রুত হয় ঠিকই, কিন্তু ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমরা গরু দিয়ে জমি চাষ করি।’
বাড়ির আঙিনায় কেউ কেউ এখনও লাঙল ও মই রেখে দিয়েছেন। সেগুলো যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের নীরব সাক্ষী। এক সময় লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়ীহাট ছিল কৃষিপণ্যের কেন্দ্র। এখানে গরুর গাড়ির চাকা, লাঙল, জোয়াল, মইসহ নানা কৃষিপণ্য কেনাবেচা হতো। আজ সেই হাটও আর নেই, হারিয়ে গেছে সেই কোলাহল ও প্রাণ।
জেলায় আধুনিক কৃষির প্রভাব এখন স্পষ্ট। উৎপাদন বাড়ছে, সময়ও বাঁচছে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে পরিচিত গ্রামীণ দৃশ্যপট। ভোরের আলোয় কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে মাঠে যাওয়া কৃষক, গরুর দড়ি ধরে ‘হেই-হেট’ ধ্বনিতে তাদের পথ দেখানো, কিংবা রাখালের রাখালিয়া সুর।
বড়বাড়ী এলাকার প্রবীণ কৃষক আজাহার আলী বলেন, ‘ফজরের আজানের আগেই গরু নিয়ে মাঠে যেতাম। গরু শুধু পশু ছিল না, পরিবারের সদস্যের মতোই ছিল। এখন সব যন্ত্রে হয়, কিন্তু সেই মাটির টান আর গরুর সঙ্গে যে হৃদ্যতা ছিল, তা আর ফিরে আসে না।’
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন বলেন, গরু বা মহিষ দিয়ে হালচাষ পরিবেশবান্ধব হলেও সময়ের দাবি পূরণে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারই এখন জরুরি। কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।
সাইখুল আরিফিন আরও বলেন, জেলায় এখন আর আগের মতো গরু দিয়ে হালচাষ দেখা যায় না। হাতে গোনা কয়েকজন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখলেও সময়ের প্রয়োজনে সেটিও হয়ত ইতিহাসে পরিণত হবে।