দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য খুলনা ওয়াসা, শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি

খুলনা ওয়াসা বিগত সরকার আমলে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তুরস্ক থেকে ২৭ কোটি টাকার পানির মিটার কিনতে কর্মকর্তাদের তুরস্কে যাওয়া-আসার ভ্রমণ ভাতা বাবদ ব্যয় হয় ৬ কোটি টাকার ওপরে। সেই মিটার আবার তিন বছরে নষ্ট। আর নষ্ট মিটার ওয়াসার তিনটি গোডাউন থেকে রহস্যজনকভাবে চুরি হয়েছে। এরপর থানায় জিডি ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সংশ্লিষ্ট কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খুলনা ওয়াসার এই দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন বর্তমান পরিচালনা বোর্ডের দুই সদস্য।
২০০৮ সালের ২ মার্চ খুলনা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ [ওয়াসা] প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে সরকার পরিবর্তনের ছয় মাস পর্যন্ত টানা ১৬ বছর প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ পিইএনজি। তখন বোর্ড চেয়ারম্যান ছিলেন তালুকদার আব্দুল খালেক। আওয়ামী লীগনেতা আমিনুল ইসলাম মুন্না, যুবলীগ সভাপতি আনিসুর রহমান পপলু, আওয়ামী লীগনেতা আশরাফ হোসেন, কাজী আমিনুল হক সহ দলীয় নেতারা ছিলেন পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। এসময় বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সদস্যদের নিয়োগ দিতে শেখ হেলাল উদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ডিও লেটার দিতেন।
এই সময় পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ২৬ হাজার কোটি টাকার কাজ হয়; যার বড় অংশ শেখ বাড়ি আর কর্মকর্তাদের পকেটে যায়। সেই সব কর্মকর্তারা আজ ভোল পাল্টে ইউনিয়ন নেতাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আগের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে।
খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের জন্য প্রথমে চীন থেকে পানির মিটার কেনা হয়। যা আজও সচল রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৮ সালের পর চীনের মিটার বাদ দিয়ে তুরস্ক থেকে মিটার কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কয়েক দফায় এই পানির মিটার কেনা হয় মোট ২৭ কোটি টাকার। আর এই পানির মিটার দেখতে কয়েক দফা তুরস্কে যান তৎকালীন এমডি আবদুল্লাহ, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল হোসেনসহ একাধিক কর্মকর্তা। আর তাদের ভ্রমণভাতা বাবদ ওয়াসার মোট ব্যয় দেখানো হয় ৬ কোটি টাকার বেশি।
খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে এনটিভিকে জানান, তিনটি গোডাউন থেকে পৃথক পৃথক সময়ে রহস্যজনকভাবে এই খোলা মিটার চুরি হয়েছে। গোডাউনে মিটারের চেয়ে দামি পণ্য থাকলেও চোরেরা সেগুলো নেয়নি। একইভাবে গোডাউনের তালা সঠিক রয়েছে। আবার সিসি ক্যামেরায় কোনো ফুটেজ নাই, দারোয়ানও দেখেনি।
সচিব আরও জানান, এ ব্যাপারে থানায় তিনটি জিডি এন্ট্রি করা হয়েছে এবং পৃথকভাবে তিনটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেছে।
এ ব্যাপারে সাবেক এমডির আস্থাভাজন পানির মিটার কিনতে তুরস্কে যাওয়া নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল হোসেনের কাছে চুরি যাওয়া বিষয় জানতে চাইলে প্রথমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলেন- তিনি শুধু নকশা করেন, অন্য কোনো দায়িত্বে নেই। মিটার কেনার জন্যে তুরস্ক যাওয়ার কথা জানালে তিনি দায়সারা উত্তর দেন।
এদিকে তিনটি গোডাউন থেকে রহস্যজনকভাবে মিটার চুরির বিচার চেয়ে বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন খুলনার নাগরিক সমাজ।

সঠিক তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবি করে নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার এনটিভিকে বলেন, লুটপাট ধামাচাপা দিতে এই মিটার চুরির নাটক সাজানো হয়। গ্রাহকের পানির বিল ধামাচাপা দিতে মিটার ঘোলা ও চুরি দেখানো হয়েছে।
খুলনা ওয়াসার অপর নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম এনটিভিকে জানান, ঘোলা মিটার চুরি যাওয়াটা রহস্যজনক। আমার ধারণা, অনিয়ম ধামাচাপা দিতেই এই রহস্যজনক চুরির ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
খুলনা ওয়াসার সদ্য ডিএমডি ঝুমুর বালা বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। আমি তো সবেমাত্র যোগদান করেছি। তাই সবকিছু আমার জানা নেই।

পরিচালনা বোর্ডের বর্তমান দুই সদস্য শেখ দিদারুল আলম ও ইব্রাহিম খালিল দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, ওয়াসা বিগত সরকারের আমলে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। আমরা বিগত আমলের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।