এক সন্ধ্যায় মিথিলার সঙ্গে
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/09/30/photo-1569842163.jpg)
খুব দ্রুত কাশবনে সন্ধ্যা নেমে এলো। ক্রমে ফিকে হলো ক্ষণিক আগেও দেখা গুচ্ছ সাদা মেঘ, উজ্জ্বল নীল আর সূর্যের হলুদ আভা। অস্তরাগের মৃদু হাওয়ায় দুলে উঠল মিথিলার মোহময় আঁচল।
আমরা গাড়িতে উঠলাম। হালকা অন্ধকারেও স্পষ্ট অভিনেত্রীর কপালের ছোট্ট টিপ। ইদানীং অবশ্য না অভিনয়ে নিয়মিত, না গানে। ব্যস্ত তাঁর উন্নয়নকর্মীর জীবন। রূপসী, সুঅভিনেত্রী, সুকণ্ঠি—তিনি রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা। হালে কাজের জন্য না এলেও প্রেমের গুঞ্জনে শিরোনাম হচ্ছেন দুই বাংলার বিনোদনপাতায়। আমাদের গল্প হলো শুরু।
কুশল জানতেই বললেন, ‘ভালো আছি।’ বললাম, একটা কিছু বলুন। হেসে বললেন, ‘তুমি কেমন আছ?’ বললাম, এভাবে না। কৈশোরে পড়া একটি চিঠির কয়েক চরণ মনে পড়ল—‘বিনতা, কথা বলো। কেন এ জ্বলন্ত প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছ মম। অন্তরে নিভায়ে ফেলো শত অভিমান, দাহ। মনে কি পড়ে না বিনতা, হয়তো ভালোভাবে জানো সেই কুসুম রাতের কথা—তোমার হাত ছুঁয়ে বলেছিলাম, একটা কিছু বলো।’ ঠোঁটে হাসির ঝিলিক এনে মিথিলার আলতো জিজ্ঞাসা, ‘বিনতা... নিজেকে বিনতা ভেবে বলব?’
মিথিলা বললেন, ‘আমার কাছে পৃথিবীটা অনেক বড় আর জীবনটা অনেক ছোট। সেই বড় পৃথিবীতে আমার ছোট্ট জীবনটাকে একটু নিজের জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।’
কারো হাত ছুঁয়ে কখনো কিছু বলেছেন? শব্দে জোর টান দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর এক নিশ্বাসে, ‘অনেক কিছু বলেছি। হাত ছুঁয়ে পাশে থেকো বলেছি। ভালো থেকো বলেছি। ভালোবাসি বলেছি। ফিরে এসো বলেছি। চলে যাও বলেছি।’ আর মন ছুঁয়ে? ‘সে কি আর মুখ দিয়ে বলা যায়, মনে মনে বলেছি।’
শ্যাওলা রঙের আঁচল আর মাটি রঙের শাড়ি পরেছিলেন মিথিলা। কালো ব্লাউজ আর ম্যাচ করে কালো টিপ। গাড়িতে ওঠার আগে কুড়িল বিশ্বরোড ধরে পূর্বাচলের দিকে ৩০০ ফুট, সড়কপাশের বিস্তৃত দিগন্তে কাশের বনে চলেছিল স্থিরচিত্রধারণ। দিয়েছিলেন নানা ভঙ্গিতে পোজ। বললাম, আপনাকে তো আমরা লাস্যময়ী, হাস্যময়ী, আবেদনময়ী, মিষ্টি, আদুরে—কত বিশেষণই না দিতে পারি। কিন্তু নিজেকে কী বিশেষণ দেবেন? মিথিলা একটু ভেবে দুধসাদা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আমি আসলে প্যাঁচ বুঝি না। আমার ভেতরেও যা, বাইরেও তা। সেটাকে কী বিশেষণে বিশেষায়িত করব, জানি না। আমি ভণিতা পছন্দ করি না। সরল বলা যেতে পারে।’ শেষে আমরা ‘সরলা দেবী’তে পৌঁছালাম।
এখন যেমন, শৈশবে ঠিক উল্টোটা ছিলেন মিথিলা। অন্য রকম ছিলেন। বললেন, ‘শৈশবে চুপচাপ ছিলাম। অন্তর্মুখী ছিলাম। নিজের মতো থাকতে পছন্দ করতাম। প্রচুর বই পড়তাম।’
মিথিলার প্রিয় বইয়ের তালিকা দীর্ঘ। তবে বারবার পড়া বইয়ের মধ্যে রয়েছে সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, ‘গর্ভধারিণী’। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ খুব প্রিয় তাঁর। নিজেকেও কখনো-সখনো নিঃসঙ্গ মনে হয়। কণ্ঠের উত্তাপ নিভিয়ে বললেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় একা থাকলেও নিঃসঙ্গ নই; আবার ভিড়ের মাঝেও নিঃসঙ্গ।’
মিথিলার সৌন্দর্যচেতনা সারল্যে, স্বচ্ছতায়। নাটক-বিজ্ঞাপনচিত্রে অন্যের জন্য সাজতে হয়। প্রদর্শনবাদিতা থাকে। কিন্তু বাস্তবজীবনে মেকআপ ছাড়াই চলেন-ফেরেন। প্রতিদিন সকালে অফিস করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে মাথা আঁচড়ে বেরিয়ে পড়েন। শুধু নিজের জন্যও মাঝেমধ্যে সাজেন। কপালে টিপ আর একটু কাজল—ব্যস, মিথিলার সাজুগুজু শেষ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মিথিলার মনে হয়, ‘কখন এত বড় হলাম! ছোট থেকে আয়নায় নিজেকে দেখি। কখনো-সখনো সেই ছোট্ট মিথিলাকে দেখতে পাই। ফের মনে হয়, কখন এত বড় হলাম আমি?’
হুট করেই কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার দুচরণ মনে পড়ে—‘টিয়ারং শাড়ি, পাড়ের সঙ্গে ম্যাচ করে পরা জামা/ জানি, এ সবই বিপণীলব্ধ, শুধু তুমিই তুলনাহীনা।’ আবরণহীন, আভরণহীন মিথিলা কেমন? নিজের সর্বাঙ্গ-রূপ তাঁর চেয়ে বেশি কে-ই বা দেখেছে! অভিনেত্রী বললেন, ‘বিপণিলব্ধ মানে তো কিনতে পাওয়া যায়। আমি তুলনাহীনা কি না জানি না, তবে বিপণিলব্ধ নই।’
দেখুন ভিডিওতে :
অভিনয় আর গান দিয়ে প্রচারের আলোয় এলেও মিথিলা এখন একেবারেই অনিয়মিত। তবে ব্যস্ততা রয়েছে। দীর্ঘদিন তিনি একটি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত। ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের শিশুবিকাশ প্রকল্পের প্রধান।
‘আমি অনেক বড় দায়িত্বপূর্ণ একটা কাজ করি। শিশুদের জন্য কাজ করি। ব্র্যাকে আমরা যে কাজটা করি—শিশুদের শিক্ষাটাকে প্রমোট করি। খেলার মাধ্যমে শিক্ষণপ্রক্রিয়া। সেটা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হচ্ছে। আমাকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রচুর যাতায়াত করতে হয়। নানা ধরনের কর্মশালায় যোগ দিতে হয়। খেলার মাধ্যমে শেখার কারিকুলামটা কেমন হবে, শিক্ষকদের কীভাবে তৈরি করব—আসলে বাচ্চারা খেলার মাধ্যমেই শেখে—কীভাবে বাবা-মায়েদের সেই মানসিকতা তৈরি করব, ইত্যাদি নিয়ে আমাদের প্রচুর প্রশিক্ষণ-কর্মশালা করতে হয়। এসব কারণে আমার হাতে খুব কম সময় থাকে। নাটক বা গান, যেকোনো কিছুই ভালো করে করতে হলে প্রচুর সময় দিতে হয়। দিতে পারি না। অবশ্য ছুটির দিনগুলোতে চেষ্টা করি নাটক বা গানে সময় দিতে। অভিনয় করতেও তো খুব ভালোবাসি। সময় পাই না।’
মিথিলার নিজেরও সাড়ে ছয় বছরের আদুরে কন্যাসন্তান আছে। নাম আইরা। ওর ভাষায়, ‘আই অ্যাম সিক্স প্লাস।’ বাবা সংগীতশিল্পী-অভিনেতা তাহসান খান। অবশ্য মিথিলা-তাহসান দম্পতির বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন কন্যাই তাঁর সব। মিথিলার ভাষায়, ‘আমার মেয়ে আমার জীবনের ধ্রুবতারা। জীবনের সবটুকু। ঘুম থেকে উঠেই ওর মুখখানা দেখি।’ বাংলাদেশে শিশুনির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন তিনি। বলেন, শিশুর জন্য দূষণমুক্ত, সহিংসতামুক্ত, শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী দেখতে চান। শিশুনিরাপত্তা নিয়ে নিরলস কাজ করে যাবেন।
যদি জীবনকে সম্পাদনা করার সুযোগ হতো, কী ছেঁটে ফেলতেন? মিথিলার সাফ জবাব, কিছুই ছাঁটতে চান না। সব মিলিয়েই জীবন। আর সবটুকু নিয়েই গর্ব তাঁর।
এবার একটু দুষ্টুমি। একটু ছল। মিথিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মুহূর্তে কেউ যদি আপনার হাতের তালুতে তাঁর নাম লিখে দিতে চান, অনুমতি দেবেন? স্নিগ্ধ মুখে বললেন, ‘কেন নয়? অবশ্যই দেব।’
মিথিলার চোখে প্রেম মানে ভালোলাগা, বন্ধুত্ব। আর সেটা যদি প্রতিশ্রুতির দিকে এগোয়, তবে প্রেম মানে সমঝোতা। তাঁর মতে, সম্পর্ক আর প্রেম দুটো দুই প্রান্তের। প্রায়ই একটি গান গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা।’ তবে এবার দুলাইন গেয়ে শোনালেন। আমরা সুর মেলালাম। বললেন, ‘আমি আসলে জানি না জীবনের দিশাটা কোথায়, কোন দিকে যাচ্ছি।’
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের মুখে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বিদায়বেলায় মিথিলা বাঁ হাত বাড়ালেন। কাশের মতো ফর্সা ভেজা তালু। জানালেন, প্রায়ই ভিজে যায়। সেই সাদা তালুতে কলমের কালি লাগছেই না। এবার আঁচলে হাত মুছলেন মিথিলা। লিখে দিলাম ছোট্ট একটি শব্দ। ঘামজলে সেই নাম নিশ্চয়ই মুছে গেছে। গেছে কি? মিথিলা জানে ভালো!