৩৬ বছর পর বন্ধ হলো রাজমণি সিনেমা হল
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/10/13/photo-1570970377.jpg)
দীর্ঘদিন ধরেই প্রেক্ষাগৃহমুখী নন দর্শক। গেল এক বছরে তো প্রতি শোতে হাতেগোনা কয়েকজন দর্শককে দেখা গেছে। যে কক্ষে ছিল কারিগরি আয়োজন, যেখান থেকে বড়পর্দায় ভেসে উঠত নায়ক-নায়িকার উজ্জ্বল মুখ, সেই কক্ষটিতে ধুলো জমেছে। মলিন মেঝেতে পড়ে আছে সেই অ্যানালগ যুগের রিল। অথচ ৩৬ বছর আগে ১৯৮৩ সালে যখন প্রেক্ষাগৃহটি আলোর মুখ দেখেছিল, কী ভিড় সিনেপ্রেমীদের। একটি টিকেট পাওয়ার জন্য হট্টগোল-হাতাহাতিও হতো দর্শকদের। সেসব এখন অতীত।
সমস্ত আনন্দের স্মৃতি মানুষের মনে জমা রেখে অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে অবস্থিত রাজমণি সিনেমা হলটি। গত শুক্রবার হয়েছে শেষ শো। আজ রোববার সরেজমিনে প্রেক্ষাগৃহ ঘুরে দেখা গেল অন্ধকারচ্ছন্ন হলের অন্দর। এক কোনায় হালকা আলোয় জ্বলছে হলদে আলোর বাতি। ধুলোভরা শূন্য আসনের সারি। হলজুড়ে হাহাকার।
রাজমণি সিনেমা হলের মালিক মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মণি। আক্ষেপ করে এনটিভি অনলাইনকে তিনি বললেন, সিনেমাই নেই আর হল থাকবে কী করে! এই হলের পর্দায় আর উঠবে না কোনো চলচ্চিত্র। জানালেন, ভবনটিই ভেঙে ফেলা হবে। সেখানে গড়ে উঠবে বহুতল ভবন। একসময় এই ভবনে শুধু চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক কার্যালয়ই ছিল ৪০টি। নতুন ভবনে অন্যান্য অফিস হলেও সম্ভবত চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক কিছুই থাকবে না।
ভবনের নিচে টিকেট কাউন্টারের দেয়ালে এখনো লেখা আছে ‘রিয়ার ৭০ টাকা’। দুজনকে দেখা গেল পোস্টার ছিঁড়তে। লুঙ্গি পরা এক ভদ্রলোক এই প্রতিবেদকের কাছে এলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আর তো হল চলবো না। ছবি তুইলা কী করবেন। আহা, কত স্মৃতি!’
কেন বন্ধ হলো রাজমণি? নির্মাতা ও হল মালিক আহসান উল্লাহ মণি বলেন, ‘ছবির অভাবে। ফিল্মের অভাবে। চলচ্চিত্রের অভাবে। বন্ধ হয়ে গেছে—ছবি নাই। আমি একসময় সিনেমা হল মালিক সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলাম। সে সময় ৩০০ হল থেকে প্রায় ১৪০০ হল করেছিলাম। প্রায় ২০টা থেকে ১০০টা ছবি আমি বানিয়েছিলাম। এটা আমার হাতেই ডেভেলপ হয়েছিল... শাবানা, ববিতা, কবরী... এগুলো মোটামুটি আমাদের আমলেই তৈরি হয়েছিল।’
দেখুন ভিডিওতে :
২৬ বছর ধরে রাজমণিতে মেশিনম্যান হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ রুবেল। তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় ঢুকছি। অ্যানালগ চালাইছি। ডিজিটাল মেশিন দিল, তাও চালাইছি। অ্যানালগের সময় ভালোই ছিল। ভালোই চলত ছবি। ডিজিটাল আসার পর মোটামুটি হইল। এখন সিনেমাই নাই, দর্শক হইবো কোত্থিকা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুবেল বললেন, ‘এত বছর কাম করলাম। মায়া লাগতাছে খুব। হলে কাম নাই, এরপর রিকশা চালাইতে হইব।’
রাজমণির আসন মেরামতকারী মোহাম্মদ জালাল। বললেন, ‘২০ বছর ধরে সিট মিস্ত্রির কাজ করছি। আগে হাউসফুল হইতো। শুক্রবার টিকেটের জন্য মারামারিও হইতো। সিট নষ্ট হইতো। ঠিক করতাম। এহন কাজকাম নাই।’
রাজমণি হলের ভবনেই ‘মিনি সিনেমা’ হল রাজিয়া। আগামী সপ্তাহ থেকে সেটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজিয়ার টিকেট কাউন্টারে কথা হলো বিক্রেতা কফিল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘রাজিয়াও বন্ধ হইয়া যাইবো। বিল্ডিং ভাইঙ্গা লাইবো। কী চলবো আর? হলের চাইতে ভালো দেহা যায় মোবাইলে। নেট বাইর হইয়া সব শেষ।’ জানালেন, রোববার মাত্র আটটি টিকেট বিক্রি করেছেন। চলছে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত পুরোনো ছবি ‘নাচ রূপসী’। আগামী সপ্তাহে রাজিয়াও বন্ধ হয়ে যাবে।
দীর্ঘদিন ধরেই ভালো সিনেমা হচ্ছে না। আর তাই কমে যাচ্ছে হলের সংখ্যা। ব্যবসাই নেই। রাজমণির মালিক আহসান উল্লাহ মণি আক্ষেপ করে আরো বলেন, বাংলাদেশ থেকে একদিন চলচ্চিত্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজমণি সিনেপ্লেক্স। সেটি চলবে। আর তাঁর নতুন সিনেমা চলবে সেখানে। ভারতেও মুক্তি দেবেন।