হৃদয়ের গহনে কোথাও বাজে ‘গহনযাত্রা’

‘গহনযাত্রা’ নাটক যেন আজকের কথাই বলতে এসেছে। আজকের কথা যখন জঙ্গিবাদ নিয়ে রাস্তায়, চায়ের দোকানে, ইন্টারনেটে এবং পত্রিকার পাতায় তর্ক-বিতর্ক চলে হরহামেশা। ঠিক এ সময় গহনযাত্রা—দ্বৈত ও অদ্বৈতের আখ্যান। এভাবেই এ মঞ্চনাটকের পরিচিতি দিয়েছেন নাট্যকার। রুবাইয়াৎ আহমেদের রচনা ও সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় পদাতিক নাট্য সংসদের (টিএসসি) নতুন প্রযোজনা ‘গহনযাত্রা’। নাটকে একক অভিনয় করেছেন শামছি আরা সায়েকা।
গত ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় এ নাটকের বিশেষ মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হলো শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। এ প্রদর্শনী ছিল অন্য সব প্রদর্শনী থেকে বিশেষ। ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল পদাতিক নাট্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদক নাট্যজন আবু মুহাম্মাদ মুরতাঈশ কচির ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে পদাতিক নাট্য সংসদ (টিএসসি) আয়োজন করেছে ‘গহনযাত্রা'র প্রদর্শনী।
নাটকটির কাহিনীতে এই ভূখণ্ডের কোনো এক স্থানে জন্ম নেয় উগ্রপন্থার। সেই উগ্রপন্থার অনুসারীরা বিপরীত সব মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে শুধু একটি মতবাদকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ জন্য তারা চালায় ধ্বংসলীলা। বইয়ে দেয় রক্তগঙ্গা, হত্যা করে অগণিত মানুষ, ধর্ষিত হয় অসংখ্য নারী। ভিন্ন মতাদর্শের এক ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষকে তারা ধরে নিয়ে বন্দি করে রাখে। বন্দিদশা থেকে পালাতে চায় অনেকে, কিন্তু মারা পড়ে তারা। শুধু একজন বেঁচে যায়। সালমা। বেঁচে গিয়ে ফিরে আসে সালমা, খোলা প্রান্তরে পড়ে থাকা লাশগুলো সমাহিত করবে বলে। এ সময়ে সালমা নিজের অভ্যন্তরে টের পায় অপর কারো অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্ব হয়তো তারই বর্ধিত কোনো রূপ কিংবা অপররূপে সে নিজেই অথবা অন্য কিছু। আমরা জানি না। সেই অস্তিত্ব সঙ্গী হয় তার। মৃতদের কবর দেওয়ার পর সালমা খোঁজ করে তার প্রার্থিত পুরুষের। খুঁজে পায় ল্যাম্পপোস্টে। ছিন্ন মস্তক ঝুলে আছে সেই পুরুষের। এগিয়ে যেতে থাকে নাটকের কাহিনী।
শামছি আরা সায়েকা, যিনি ‘সালমা’ হয়ে মঞ্চে ফুটে ওঠেন, তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল এ নাটক নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সালমা এমন এক নাম, যা নিরপেক্ষ, ইসলাম বা ইহুদি ধর্মের যেকোনো নারীকে বহন করে এ নাম। এ নাটকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের কথা যদি বলতে হয় তবে আমি বলব, স্ক্রিপ্টের কথা। দিনের পর দিন লেগেছে আমার এই কাহিনীকে, এই নাটকের চিত্রনাট্যকে নিজেকে নিজেরই বোঝাতে। আমি অনুশীলন করেছি, পড়েছি, অনেক মানুষের সহায়তা নিয়েছি যেন কোনো অর্থ বদলে না যায়। যেন একটা শব্দেরও হেরফের না ঘটে। শুধু এ জন্যে।’
নাটকে সালমা মৃতদেহকে তুলে ধরার সময় সাদা রঙের মুখোশকে ব্যবহার করেন। একেকটা শব্দে তখন সে কী আকুতি! আবার নীল রঙে আনন্দ কিংবা বেদনার দ্বন্দ্বে মাঝেমধ্যে দুলে ওঠে দর্শক পোশাক পরিকল্পনার জাদুতে।
সালমার কোন অংশ সবচেয়ে বেশি টানে একজন সায়েকাকে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এত সব বাস্তব উদাহরণের কথা দিয়ে আমাকে নাটকটি বোঝানো হয়েছে মহড়ার সময় যে আমি সত্যি কোনো অংশ থেকেই কোনো অংশকে কম বা বেশি বলতে পারছি না। তবে আমার খুব কষ্ট হয়, যখন চোখের সামনে প্রিয় মানুষের মৃত্যুর কথা বলি। আমার অভিনয়ের সময় খুব কষ্ট হয় ভেতরে যখন সমুদ্র-তীরের সেই শিশুর লাশ দেখতে পাই। আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, যখন এক ঘণ্টা ১০ মিনিটের নাটকের শেষের দিকে প্রার্থনা করি, আহ্বান জানাই শুভ কিছুর। সবাই যেন মঙ্গলময় পৃথিবীর জন্য সত্যি মিলিত হই। তখন খুব ভালো বোধ করি ভেতরে ভেতরে।’