আমার বাবার থেকেও বেশি প্রিয় ছিলেন মৃণাল সেন : অঞ্জন দত্ত
১৯৮১ সালে মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ে নাম লিখিয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত। কিংবদন্তি নির্মাতার সঙ্গে এই সিনেমার শুটিং চলাকাল ও এর আগে-পিছের ২৫ দিনের কিছু ঘটনা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ‘চালচিত্র এখন’ এ ফুটিয়ে তুলেছেন গায়ক-নির্মাতা-অভিনেতা অঞ্জন। দ্বাবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সপ্তম দিনে (২৬ জানুয়ারি) জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে মৃণাল সেনকে নিয়ে অঞ্জন দত্তের এই সিনেমা।
সিনেমাটির প্রদর্শনীতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে উপস্থিত ছিলেন নির্মাতা অঞ্জনও। সেখানে অঞ্জন দত্ত বলেন, ‘মৃণাল সেন না থাকলে আমি সিনেমাতে আসতে পারতাম না। তিনি আমার পৃথিবীর সিনেমার দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন। সিনেমা করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না, তিনি প্রায় আমাকে জোর করে সিনেমায় ঢুকিয়েছিলেন। এবং তারপর আস্তে আস্তে উনার সহকারী হলাম। অভিনেতা তো হলামই, উনার গল্প লিখলাম, চিত্রনাট্য, সহযোগী প্রযোজক ও বন্ধু হলাম।’
এ সময় অঞ্জন দত্ত বলেন, ‘উনার (মৃণাল সেন) শত বছর। আমার মনে হলো আমার দিক থেকে কিছু করা উচিত। আমার কোনো গানে, সিনেমায় কিংবা থিয়েটারে মৃণাল সেন আসেননি। কেন আসেননি আমি জানি না। তিনি এতই ব্যক্তিগত যে, দূর থেকে তাকে দেখতে আমার সময় লেগেছে। দূর থেকে না দেখলে তাকে নিয়ে কী করে আমি সিনেমা করব? মাথায় তুলে মৃণাল সেন একটা বিশাল লোক, এটা আমি বলতে পারব না। তিনি মানুষ, আমাদের মতোই মানুষ, মজার মানুষ। তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন, শিখিয়েছেন। কিন্তু তাকে আমি ওরম মহান ব্যক্তি হিসেবে দেখিনি। মানুষ হিসেবেই দেখি, যেটা আমার কাছে খুব বড় পাওয়া। তাই তাকে নিয়ে সিনেমা বানাতে সময় লাগল।’
সিনেমায় মৃণাল সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অঞ্জন দত্ত। আরও আছেন শাওন চক্রবর্তী, সুপ্রভাত দাস, বিদীপ্তা চক্রবর্তী প্রমুখ।
সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে উনার (মৃণাল সেন) অনেক পলিটিক্যাল দ্বিমত ছিল, আছে, থাকবে। তবুও আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। আমার বাবার থেকেও বেশি প্রিয় ছিলেন, আমার সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়। কিন্তু রাজনৈতিক জায়গা থেকে আমাদের কমপ্লিটলি (পুরোপুরি) ভিন্ন মতামত ছিল। কমপ্লিটলি বলব না; কারণ কমপ্লিটলি বলাটা উচিত নয়। যেকোনো শিক্ষিত মানুষই একটু বাম-ঘেষা হয়। কিন্তু তিনি বলতেন, উনি প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট। মানে ব্যক্তিগত মার্ক্সিস্ট। আর আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, কোথাও গিয়ে প্রকৃত অর্থে সোশ্যালিজম দাঁড়ায় না। সেটা ক্ষমতার অপব্যবহার হয়। এই দুটো ভিন্ন মতবাদ ছিল, তবুও আমরা বন্ধু ছিলাম।’
যোগ করে আরও বলেন, ‘এই দ্বন্দ্বটা সিনেমায় আমি রেখেছি। সেটা বাদ দেওয়া যেত, কিন্তু দিইনি আমি। মৃণাল সেনের সঙ্গে বিপরীত মতামতে দাঁড়ানো যেত। এবং দুটো ভিন্ন মানুষ, সেটা তিনি গ্রহণ করতেন। তাঁর নিজের যা অভ্যেস নেই, কিন্তু আরেকটা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের (উনার সিনেমাটোগ্রাফার কে. কে. মহাজন) সঙ্গে সারাজীবন কাজ করেছেন। তিনি জীবনে এক ছিপি মদ্যপান করেননি, কিন্তু কে.কে. মহাজন সাংঘাতিক মদ্যপান করতেন। কীভাবে দুটো মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন? এই যে নিজের বিপরীতের আরেকজন মানুষকে কাছে টেনে নেওয়া, সেটা তিনি করেছেন। যাই হোক, আমার ছবিতে আমিও সেটা করেছি। আমার মনে হয়, একটা পয়েন্টে দর্শককে তা অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। সেই অর্থে এটা অস্বস্তি কিনা জানি না, তবে একটা বিতর্কে আমি ঢুকেছি ছবিটা নিয়ে।’