ইউটিআই রোগের কারণ ও লক্ষণ

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই একটি সাধারণ রোগ হলেও সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। আজ ১০ জুলাই, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯২তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন দেশের খ্যাতনামা কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের কিডনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক।
প্রশ্ন : ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই বিষয়টি কী?
উত্তর : ইউরিনারি ট্র্যাক্ট মানে হলো যে রাস্তা দিয়ে প্রস্রাব বের হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, কিডনি প্রস্রাব তৈরি করে। তার পর কিডনি থেকে ইউরেটার নল দিয়ে ইউরিনারি ব্লাডারে প্রস্রাবটা আসে। এর পর প্রস্রাব ইউরিথ্রা দিয়ে বের হচ্ছে। এই পুরো জায়গাটা, অর্থাৎ ইউরেটার থেকে শুরু করে ইউরিথ্রা পর্যন্ত এই পুরো ট্র্যাক্টটাকে ইউরিন ট্র্যাক্ট বলি। এই জায়গাটার কোনো অংশে যদি সংক্রমণ হয়, তাকে ইউরিন ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বলা হয়।
প্রশ্ন : একজন মানুষ সাধারণত ইউটিআইতে আক্রান্ত হন কেন?
উত্তর : ইউটিআইয়ে আক্রান্ত হওয়ার কারণ কিছু ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। আর কিছু রয়েছে হোস্ট ফেক্টর, অর্থাৎ ওই লোকটার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অথবা তাঁর ইউরিনারি ট্র্যাক্টের কোনো সমস্যা আছে। এটা একটা সংক্রমণ তৈরি করতে পারে। কাজেই ফ্যাক্টর দুটো। যিনি রোগী তাঁরও কিছু ফ্যাক্টর থাকবে। আরেকটি হলো জীবাণু থেকে সংক্রমণ।
প্রশ্ন : এর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বা নারী-পুরুষভেদে কোনো বিষয় আছে কি?
উত্তর : ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা খুব বড় একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে। ধর্মীয় মতে বলা আছে, প্রস্রাব করার পর ভালোভাবে পরিষ্কার করার কথা। পরিষ্কারের বিষয়টি ভালোভাবে মেনে চলতে হবে। আর মেয়েদের বেলায় ইউরিন ট্র্যাক্ট ইনফেকশন খুব বেশি হচ্ছে। কারণ, মেয়েদের পায়খানার রাস্তা এবং প্রস্রাবের রাস্তাটা খুব কাছাকাছি থাকে, তাই এটা বেশি হয়। আরেকটি কারণে হয়, আমাদের দেশে মেয়েরা দীর্ঘ সময় প্রস্রাব ধরে রাখে। তারা হয়তো বাইরে গেল তখন প্রস্রাবের কোনো ভালো জায়গা পায় না। প্রস্রাব করার সুযোগ পায় না। এটাও এ রোগ হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
প্রশ্ন : নিয়মিত প্রয়োজনমতো পানি না খাওয়া কি ইউটিআই হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে কি না?
উত্তর : আপনি জেনে থাকবেন, আমরা কিছু কিছু কিডনি রোগের ক্ষেত্রে পানি কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। আবার কিছু কিডনি রোগে বলি পানি বেশি খাবেন। ইউরিন ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে আমরা বলি পানি বেশি খেতে, যাতে প্রস্রাব বেশি করে হয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলো বের হয়ে যায়।
প্রশ্ন : একজন মানুষ যদি ইউটিআইতে আক্রান্ত হন, সে ক্ষেত্রে তাঁর কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে?
উত্তর : শুরুতে দেখা যায়, তাঁর প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কখনো লাল প্রস্রাব হতে পারে। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। তার পর জ্বর শুরু হতে পারে। ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে এই জ্বর আসবে। এই লক্ষণ যদি কারো ক্ষেত্রে হয়, তবে আমরা ধরেই নেব এটা ইউটিআই।
প্রশ্ন : এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আপনারা কী করেন?
উত্তর : এ রকম লক্ষণ নিয়ে আসলে আমরা প্রস্রাবটা পরীক্ষা করি এবং কালচার সেনসিটিভিটি দিই। কালচার মানে হলো, ব্যাকটেরিয়াকে কালচার করে আমরা দেখতে পারি কোন ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে রোগী আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি সেনসিটিভিটি বা স্পর্শকাতরতা পরীক্ষা করি। সেনসিটিভিটির মাধ্যমে দেখি কোন ওষুধ এখানে কাজ করবে। ইউটিআই আসলে খুব সাধারণ অসুখ। তবে সময়মতো যদি অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া হয়, তাহলে এর থেকে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : আমাদের মধ্যে অনেকেরই অভ্যাস রয়েছে, না বুঝে হোক বা গাফিলতির জন্য হোক, অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পর সেটা নিয়মিত না করা। ইউটিআইর ক্ষেত্রে যদি একজন রোগীকে ওষুধ দিলেন, কিছুদিন পর সে ভালো হয়ে গেছে মনে করল এবং ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল—কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : এতে খুব ক্ষতি হবে। আমরা ৭ থেকে ১৪ দিন একটি অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স দিই। ইউটিআই এমন একটি বিষয়, দুদিন ওষুধ খেলে দেখবেন তার কোনো লক্ষণ থাকবে না। তখনই অনেক সময় সে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে যখন তার ইউটিআই হবে দেখা যাবে, ওই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না তার ক্ষেত্রে। এমনও দেখা গেছে, প্রায় ১৬ থেকে ২০টা অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসটেন্স হয়ে গেছে। এর কারণ হলো আমরা যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি এবং সময়মতো করি না। সে জন্য ওষুধ আর কাজ করছে না।
প্রশ্ন : কেউ ইউটিআই রোগে আক্রান্ত হলে যদি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না নেয়, তাহলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : আমরা জানি, ক্রনিক কিডনি রোগের একটি বড় কারণ বার বার ইউরিন ট্র্যাক্ট ইনফেকশন হওয়া। ইউরিন ট্র্যাক্ট ইনফেকশন যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, সেখান থেকে কিডনি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। একবার যদি এমন অবস্থা হয়ে যায়, তাহলে সে শেষ পর্যায়ে চলে যাবে, ডায়ালাইসিস লাগবে। কাজেই সাধারণ মনে হলেও ইউটিআই সাধারণ নয়। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এটা অত্যন্ত গুরুতর অবস্থায় চলে যেতে পারে।
প্রশ্ন : ইউটিআই প্রতিরোধে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : প্রস্রাব বেশিক্ষণ ধরে রাখা যাবে না। প্রস্রাব করতে হবে ঠিকমতো। কখনো যদি এই রোগের চিকৎসা করেন, তবে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করতে হবে। সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক সেবন এবং কোর্স পূর্ণ করতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, ইউটিআই পরীক্ষার সময় কালচার সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। যদি না করা হয় তাহলে কি কোনো ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : এটা করা ভালো। ধরুন, একজন রোগী আমাদের কাছে এলো, আমরা একটি অ্যান্টিবায়োটিক তাকে দিয়ে দিই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলি, অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করবেন ইউরিন কালচার করতে দিয়ে। এই ফলাফল আসে তিন দিনের মধ্যে। তখন দেখি, ওই কালচারে কোন অ্যান্টিবায়োটিকটা স্পর্শকাতর। যদি দেখি যেই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে, সেটিই স্পর্শকাতর হচ্ছে বা সাড়া দিচ্ছে, কাজ করছে তবে সেটাই চলবে।
প্রশ্ন : ইউটিআই হলে আপনারা বলেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে। এই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান মানে কী? আর এই রোজার সময় তো অনেকের পানি পান করা কমে যায়। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : রোজার সময় পানি পানের চাহিদাটা বেড়ে যায়। তাই ইফতারের পর থেকে সেহরি পর্যন্ত পানি ভালোভাবে খেয়ে নেবেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের গড়ে দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করলে চলবে।
প্রশ্ন : আর যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হোন তাঁদের বেলায়?
উত্তর : যতটুকু প্রস্রাব হবে তার থেকে আধা লিটার বেশি পানি পান করবে। অথবা চিকিৎসকের পরামর্শমতো পানি পান করবেন।