সহিংসতা এবং মনোরোগ

সহিংসতার কারণে বিভিন্ন ধরনের মনোরোগ হয়। যে এর শিকার হয়, তার মধ্যে আতঙ্ক, উদ্বেগ কাজ করে। এর থেকে পরবর্তী জীবনে সমস্যা হতে পারে। আজ ৩ আগস্ট, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১০৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামসুল আহসান মাকসুদ।
urgentPhoto
প্রশ্ন : সহিংসতা বলতে আমরা কী বুঝি? এবং এই সহিংসতার সঙ্গে মনোরোগের সম্পর্ক কী?
উত্তর : কোনো আচরণ যদি ব্যক্তির গ্রহণের মাত্রার বাইরে চলে যায় এবং যদি ওই ব্যক্তির সামাজিক ও মানসিক অবস্থা নষ্ট হয়, তখন সেটাকে সহিংসতা বা সহিংস আচরণ বলতে পারেন।
অবশ্যই যেকোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটলে ব্যক্তির মনের ওপর চাপ পড়বে। তার শারীরিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে মনের সমস্যা হবে। সে খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। বিষণ্ণতায় ভুগতে পারে। যার ওপর এই সহিংসতা করা হবে, তার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো হতে পারে। এ সমস্যার শিকার হয়ে ওই সময়ের জন্য সে আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি মনোরোগে ভুগতে পারে।
প্রশ্ন : এই সহিংসতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এবং এর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা। এটা নিয়ে কী মনে হয় আপনার? এই প্রকোপটা কেন বাড়ছে?
উত্তর : আসলে সব সময় দেখে আসছি, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। শিশুরা সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটলে তারা এর প্রতিকার করতে পারে না। প্রতিরোধ করতে পারে না। একটা বিষয় হলো, শিশুরা সমাজে দুর্বল, তাদের সহিংসতার প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই। আর দ্বিতীয়টি হলো, সাম্রাজ্যবাদে আমরা দেখি দুর্বলের প্রতি সবল শক্তির একটা প্রভাব থাকে। তাই বাচ্চারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেহেতু তারা দুর্বল। আর শিশু অধিকারকেও আমরা সুরক্ষা করতে পারছি না, এটাও সহিংসতার একটা কারণ হতে পারে।
প্রশ্ন : যারা এই সহিংসতা ঘটাচ্ছে, তারা নিজেরাও তো এই মানসিক রোগের মধ্যে পড়ে। তারাও তো মানসিকভাবে অসুস্থ বলে এই জিনিসটা তারা করতে পারে বলে মনে হয়। আমরা বিভিন্ন পরিবারে দেখতে পাই, বাবা-মা যখন সহিংসতা করে, তখনো শিশুরা এই শিকার হয়। কী বলবেন সেই বিষয়টি নিয়ে?
উত্তর : আমি এটার দুটো ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। একটা হচ্ছে, যারা সহিংস আচরণ করে, সবাই তো করে না, তবে যারা করছে, তাদের অবশ্যই কিছু কিছু আচরণ স্বাভাবিক নয়। কারণ দুর্বলের ওপর যখন সবল অত্যাচার করবে এবং সেটি যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, এটা আমরা কখনো মেনে নিতে পারি না। আর যারা এই অত্যাচারটা করছে, তাদের বিভিন্ন রকমের মনোরোগ বা আচরণগত সমস্যা থেকে থাকতে পারে।
আর যখন পরিবারের কথা বলবেন, পরিবারের ঝগড়ার ব্যাপারে আমরা সব সময় নিরুৎসাহিত করি, মা-বাবার ঝগড়ায় যেন বাচ্চাকে টেনে না নেওয়া হয়। মা-বাবার মধ্যে মতের অমিল থাকতেই পারে, তবে এর প্রভাবে বাচ্চার দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগ হতে পারে। এটার জন্য দেখা যায়, বাচ্চার পরবর্তীকালে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আবেগজনিত সমস্যা দেখা দেয়। অবশ্যই আমরা বলব, মা-বাবার মধ্যে যদি কোনো ঝগড়া থাকে, এটার যদি কোনোরকম দ্বন্দ্ব থাকে, সেটা যেন বাচ্চার সামনে বের হয়ে না যায়। মা-বাবার পারিবারিক সহিংসতার বাচ্চা শিকার হবে, এটা আমরা কোনোভাবেই আশা করি না।
প্রশ্ন : আমরা দেখেছি, যারা এ ধরনের কাজ করে, তারা নিজেদের পরিবারেও হয়তো ছোটবেলায় এ সমস্যা সে দেখেছে। এই যে রাজন হত্যার সময় আমরা দেখেছি, তারা কতটা নির্ভীক হয়েছে যে ফেসবুকেও এই হত্যার ভিডিও দিতে দ্বিধা করেনি, ভয় পায়নি। যারা সহিংসতাকারী, তারা এত কেন নির্ভীক হয়ে যাচ্ছে?
উত্তর : আসলে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা দরকার। একটা হতে পারে যে বিচার যেভাবে হচ্ছে, এর দীর্ঘ সময় লাগা বা সঠিক সময়ে সঠিক বিচার না হওয়া। তাই অপরাধীরা হয়তো মনে করে, দীর্ঘমেয়াদি বিচার এড়িয়ে যাওয়া যাবে। তাদের যে অন্যায়, এটা হয়তো ঢেকে যাবে। সে ক্ষেত্রে যারা দোষী, তাদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আর ওরা হয়তো বুঝতে পারেনি, এ বিষয়টা প্রচণ্ডভাবে সমাজকে নাড়া দেবে। আমরা মনে করি, তাদের অবশ্যই মনোবৈকল্য ছিল। কারণ, তারা যেভাবে ফেসবুকে ভিডিও দিয়েছে, এতে করে তো কোনো সম্মান নেই। তারা নিজেরাও সত্যিকার অর্থে মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী।
প্রশ্ন : দিন দিন যে এসব ঘটনা বাড়ছে, যারা সমাজে বাস করছে তাদের মনের ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
উত্তর : আমি মনে করি, টিভিতে যদি সহিংসতার কোনো ছবি দেখানো হয়, সেটা বাচ্চাদের না দেখানো ভালো। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাকশনধর্মী ছবিগুলো যদি বাচ্চারা দেখে, তাদের মধ্যে সহিংসতার মনোভাব তৈরি হয়। তাই মা-বাবার শিশুকে এ ধরনের ছবি বা দৃশ্য থেকে দূরে রাখতে হবে।
আরেকটি হচ্ছে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত না করা। যাদের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা আছে, সময় ও সুযোগের জন্য এর প্রকাশ ঘটেনি, তারা হয়তো নিরুৎসাহিত হয়ে যাবে। আমরা মনে করি, অনেকের ভেতর উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে অপরাধের প্রবণতা চলে আসতে পারে। তারা যদি দেখে এর শাস্তি হচ্ছে, তাহলে তারা আর অপরাধ করার সুযোগ পাবে না।
প্রশ্ন : আমরা অনেক সময় দেখি, মা-বাবা ছাড়াও পরিবারের অন্য লোকদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে। সেগুলো হয়তো শিশুর সামনেই হচ্ছে। এ বিষয়টি আপনি আসলে কীভাবে দেখবেন?
উত্তর : শিশুর যদি অবস্থা বলেন তাহলে আমরা বলব, মা-বাবার ঝগড়াঝাঁটিগুলো যেন শিশুর সামনে না হয়। এবং পরিবারের মধ্যে যদি কোনোরকমের মতদ্বৈধতা থাকে, তা বাচ্চাদের অনুপস্থিতিতে এর সমাধান করা উচিত। আর তাদের এমন কোনো শিক্ষা যেন না দেওয়া হয়, তারা যেন মনে না করে, সহিংসতা এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। তাদের মনে রাখতে হবে, সহিংসতা ছাড়া অন্যভাবে একটা সমস্যার সমাধান করা যায়।
আর যদি সেটা না হয়, তাহলে এসব শিশু যখন বড় হয় ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে দেখা যাবে হতাশা-বিষণ্ণতা এবং নানা রকমের উদ্বেগজনিত সমস্যা।
প্রশ্ন : এ ধরনের উদ্বেগজনিত সমস্যার কারণে যেসব বাচ্চা আপনাদের কাছে চিকিৎসার জন্য আসছে, তাদের জন্য কী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন আপনারা?
উত্তর : আমরা সাধারণত সহিংসতা তার মনোরোগের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, এটা দেখার চেষ্টা করি। যদি দেখি, শিশু তীব্র মানসিক যন্ত্রণা বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়, তখন আমরা তাকে ক্রাইসিস ইন্টারভেশন করি। যদি পরিস্থিতি খুব খরাপ হয়, তাহলে ওষুধ খেতে দিই। কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে তার চিকিৎসা করি। একটা রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট বা ঝুঁকির ধারণা করার চেষ্টা করি, ভবিষ্যতেও সে এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে কি না। তখন আমরা মা-বাবাকে বলি, বাচ্চাকে এ পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে নিরাপদ পরিস্থিতিতে রাখা ভালো। এবং মা-বাবার মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থাকে, তখন আমরা পারিবারিক পরামর্শও দিই। মোটকথা, বাচ্চাকে সুস্থ পরিবেশ দেওয়ার জন্য যা করণীয়, আমরা সেটা করার উপদেশ দিই।