জীবনে সফল হতে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কি জরুরি

সুপ্তি ও রনির বিয়ে হয়েছে দুই বছর হলো। তারা একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। কিন্তু তাদের মধ্যে হরহামেশা ঝগড়া লেগে থাকে। আর একবার ঝগড়া লেগে গেলে তা যেন থামতেই চায় না। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়।
নিলয় সারা জীবন খুব ভালো পড়াশোনা করে এসেছে। তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিও সে পেয়েছিল। মা-বাবা খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু অফিসের বসের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে চাকরিটা ছেড়ে দেয় সে। এরপর আরো কয়েকটি চাকরি একইভাবে ছেড়ে দিতে হয়। এতে তাঁর বাবা মা খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। তাঁদের মাথায় আসে না কী কারণে সে চাকরি করতে পারে না। তাঁরা কখনো নিলয়কে আবার কখনো তাঁর সহকর্মীদের দোষারোপ করেন।
পাঠক সুপ্তি, রনি বা নিলয়ের বিষয়গুলো কি ব্যতিক্রমী ঘটনা? নাকি এ রকম ঘটনা আমাদের পরিচিত বা পরিজনদের সঙ্গেও ঘটছে? হ্যাঁ, আমরা আমাদের চারপাশে তাকালে এ রকম অসংখ্য ঘটনা দেখতে পাব। কিন্তু এমনটি হয় কেন? সুপ্তি-রনি বা নিলয়ের ঘটনাগুলোতে হতাশা তৈরি হলেও তাঁদের আর কোন শারীরিক বা মানসিক সমস্যা নেই।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা আর কিছুই নয়- তাদের আইকিউ অনেক ভালো হলেও তাঁর আবেগী বুদ্ধিমত্তার (ইকিউ বা ইআই) ঘাটতি রয়েছে। তারা অন্যের সঙ্গে যথাযথভাবে মিলেমিশে থাকতে পারছে না। তাদের মনের আবেগ ( যেমন : রাগ, দুঃখ, অভিমান) এগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না বা পারলেও তা প্রকাশ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অন্যের আবেগ অনুভূতি বুঝে সে অনুযায়ী কথাও বলতে পারছে না। ফলে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বিপত্তি।
মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনের সফলতা অনেকাংশে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে। শুধু ভালো আইকিউ মানুষের সফলতার জন্য যথেষ্ট নয়, সফলতার জন্য আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত জরুরি। আইকিউ কোনো চাকরি পাওয়ার জন্য জরুরি কিন্তু আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (ইকিউ বা ইআই) মানুষের চাকরি পাওয়া ও সফলতা উভয়টির জন্যই জরুরি।
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের সফলতার জন্য তাঁর আইকিউ ২০ শতাংশ এবং আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ৮০ শতাংশ দায়ী। বাংলাদেশের একটি গবেষণায় আরো পাওয়া গেছে যেসব দম্পতির স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কম তাদের মধ্যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটার হার অনেক বেশি। অন্যদিকে যেক্ষেত্রে স্বামী আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বেশি তাদের মধ্যে নির্যাতনের ঘটনা খুবই কম। সুতরাং দাম্পত্য জীবনের সুখের জন্য আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বার অনেক ভূমিকা রয়েছে।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা কী?
আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বা হচ্ছে মানুষের এমন একটি দক্ষতা বা ক্ষমতা যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ও অন্যদের আবেগকে বুঝতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারে। ব্যক্তি নিজেকে বা তাঁর চারপাশের মানুষদের কাজে উদ্বুদ্ধ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
এই ক্ষমতা যাদের বেশি তাঁরা অনেক চাপের মধ্যেও নিজেকে শান্ত রেখে কাজ করতে পারে। তাঁরা চাপ ও চাপের প্রতি শারীরিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকেন। নিজেকে শান্ত করার প্রক্রিয়াগুলো তাঁরা সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেন। ফলে অস্থির না হয়ে পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন। চাপমূলক পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি নিজের করণীয় কাজগুলো করতে নিজেকে প্রেষিত করতে পারা যায়। ফলে পেশাগত কাজে সফলতা পাওয়া যায়।
এই ক্ষমতা বেশি থাকলে অন্যের আবেগ-অনুভূতি ধরে সে অনুযায়ী কথা বলতে ও কাজ করা সহজ হয়; ফলে তাদের আন্তব্যক্তিক সম্পর্কগুলো অনেক সুন্দর হয়। কেননা অন্যেরা বুঝতে পারেন এই ব্যক্তি তাদের অবস্থা ও অবস্থানকে বুঝতে পেরেছেন এবং তাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান ও সহানুভূতি রয়েছে। ফলে তারাও তাকে বোঝার ও সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
বড়বড় নেতাদের মধ্যে এই ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। তাঁদের ডাকে মানুষ মানবতার কল্যাণে নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতেও পিছুপা হয় না। নেতাদের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বেশি থাকে বলেই তারা মানুষের ও কর্মীদের আবেগ ভালো বুঝতে পারেন এবং তাদের মধ্যে আবেগ তৈরি করে তাঁদের বিভিন্ন কাজে প্রেষিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার মধ্যে চারটি প্রধান উপাদন রয়েছে। এগুলো হলো :
আত্ম সচেতনতা
আত্ম সচেতনতা হচ্ছে নিজের মোটিভেশন, আবেগ ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা। কি তাঁর পছন্দ বা অপছন্দ, তাঁর দুর্বল ও শক্তির দিকগুলো এবং তাঁর নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা। কোন পরিস্থিতিতে তাঁর মধ্যে কোন ধরনের অনুভূতি কাজ করে এবং ভবিষ্যতেও কোন পরিস্থিতিতে কেমন লাগবে তা বুঝতে পারা। নিজের চিন্তা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও প্রত্যাশাগুলো নিজের কাছে পরিষ্কার থাকা।
আত্মনিয়ন্ত্রণ/ব্যবস্থাপনা
এটি হলো নিজের আবেগগুলোকে সঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন আবেগময় পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা। ব্যক্তি সবসময় আশাবাদী থাকে, নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কাজ শুরু করে ও যেকোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত থাকে। প্রচণ্ড রাগও সে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের বা অন্যদের মধ্যে আবেগ তৈরিও করে নিতে পারে।
সামাজিক দক্ষতা/ সচেতনতা
এটি ব্যক্তিকে অন্যের আবেগকে বুঝে তাতে সমানুভূতি (সহানুভুতি নয়) প্রদর্শন করতে সাহায্য করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এটি অন্যকে আঘাত না করেই নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত, নিজের আবেগ-অনুভুতি সঠিকভাবে প্রকাশ, নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা, কেউ সাহায্য করতে না পারলে তা সহজভাবে মেনে নিতে, ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থনা, অন্যকে প্রকৃত প্রসংসা করতে এবং যেকোনো পরিবেশে সচেতন থেকে আলোচনা ও সম্পর্ক তৈরিসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করতে সাহায্য করে।
সম্পর্কগুলোর নিয়ন্ত্রণ/ব্যবস্থাপনা
এই ক্ষমতা ব্যক্তিকে মানুষের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি এবং ধরে রাখতে সাহায্য করে। ব্যক্তি একরোখা না হয়ে ছাড় দিতে পারে, অন্যদের উৎসাহ দিতে পারে, বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে, প্রয়োজনে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্ব দিতে পারে কিন্তু সে টিম ওয়ার্ক ও সহযোগিতামূলক পদ্ধতিতে কাজ করে।
এই উপাদানগুলোকে ব্যক্তি নিজের ভেতর অনুশীলন করলে সফলতা পাওয়া সহজ হয়। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কিন্তু আইকিউ এর মতো নয়। আইকিউ ব্যক্তির জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে কিন্তু আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা অর্জিত অর্থাৎ এটিকে প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে বৃদ্ধি করতে হয়।
তার অনুভূতিগুলোর অর্থ কী এবং এর প্রভাব কী হতে পারে তা অনুমান করে কীভাবে কাজ করলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে তা শিখতে পারে। সে রকমভাবে কাজ করে। এগুলো অনুশীলনের ফলে তার চারপাশের মানুষদের সাথে অত্যন্ত ভালো ও ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি হয়, সবাই তাকে পছন্দ করতে থাকে। তাঁর কাজে সহযোগিতা করে ও টিমের কাজে সর্বাত্মক ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে সফলতা তাঁকে আলিঙ্গন করে।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর উপায়
নিজে নিজে প্রচেষ্টা ও কোচিংয়ের মাধ্যমে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বাড়ানো যায়। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর জন্য ১৬টির অধিক গুণাবলি অর্জন করতে হয়। একেকটি গুণাবলি অর্জনের জন্য অনেক কৌশল রয়েছে। এগুলোর কিছু কৌশল এখানে আলোচনা করা হলো :
১. কী কী আবেগের নাম জানেন? একটি কাগজে লিখে ফেলুন। এর কোনগুলো আপনি নিজে অনুভব করেছেন? কবে? কোন পরিস্থিতিতে? তাও লিখুন।
২. প্রতিদিন আপনি কোন কোন অনুভূতি পেয়েছেন তা আলাদা কাগজে লিখুন।
৩. অনুভূতির সময়ে আপনার শারীরিক পরিবর্তন হয়েছিল? এখান থেকে বের করুন আপনার কোন কোন আবেগে কী ধরনের শারীরিক পরিবর্তন হয়।
৪. প্রতিটি আবেগের পিছনে কী কী চিন্তা কাজ করে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ কারো সহযোগিতা নিন।
৫. যেসব পরিস্থিতি আপনার আবেগ আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং যেসব পরিস্থিতিতে আপনার আবেগ নিয়ন্ত্রণে থাকে না তার তালিকা তৈরি করুন ও মনে রাখুন।
৬. যেসব পরিস্থিতিতে আপনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তা বিশ্লেষণ করুন। বিশেষ করে ওই সময়ে আপনার মধ্যে কী ধরনের চিন্তা কাজ করছিল তা বের করুন। চিন্তাটি ভুল না সঠিক তা বিবেচনা করুন। ভুল হলে সঠিক চিন্তাটি কী তা বের করুন।
৭. চিন্তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের মধ্যে সুখবোধ বাড়িয়ে নিন। এর জন্য অতীত ও দূর ভবিষ্যতে অবস্থান না করে বর্তমানে থাকুন।
৮. সমস্যা বা মানসিক চাপে পড়লে তা সমাধানের জন্য একাধিক উপায় খুঁজে বের করুন ও সঠিক উপায়টি খুঁজে তার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করুন। সমাধান না করা সম্ভব হলে তা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন। যেখানে কিছুই করার নেই সেখানে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করুন।
৯. আপনার অনুভূতির সাথে আপনার শারীরিক বা অবাচনিক (মুখভঙ্গি, দেহভঙ্গি ইত্যাদি) প্রকাশটি সঠিক কি না তা বিবেচনা করুন।
১০. অন্যের অবাচনিক ভাষা পড়ার চেষ্টা করুন।
১১. অন্যের অনুভূতি ধরার চেষ্টা করুন। এ ক্ষেত্রে নিজেকে তাঁর জায়গাতে কল্পনা করলে সহজে বোঝা যায়।
১২. অন্য ব্যক্তির সাথে কথা বলার সময়ে তাঁর অনুভূতি ও অবস্থানকে অনুধাবন করুন ও সেগুলো যে বুঝতে পারছেন তা প্রকাশ করুন।
১৩. অন্য ব্যক্তির সাথে কথা বলার সময়ে তাঁর অনুভূতি ও অবস্থানকে সম্মান জানিয়ে কথা বলুন।
১৪. নিজের অনুভূতিগুলো সুন্দরভাবে প্রকাশ করার অভ্যাস করুন। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ কারো ফিডব্যাক নিন। নেতিবাচক অনুভূতি জমিয়ে রাখবেন না। সেগুলোও প্রকাশ করুন।
১৫. নিজের ও অন্যদের অনুভূতি, চিন্তা ও আচরণের মধ্যে সম্পর্কটি লক্ষ্য করুন।
১৬. নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার অনুশীলন করুন।
১৭. সুন্দর করে অনুরোধ করতে, না বলতে শিখুন এবং অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলে মেনে নিতে অভ্যাস করুন।
১৮. ভুল হলে ক্ষমা চাইতে শিখুন।
১৯. প্রয়োজনীয়তা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করুন। সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পারলে নিজেকে পুরস্কৃত করুন।
২০. দলের সাথে মিলেমিশে কাজ করার অভ্যাস করুন। আদান-প্রদানের মাধ্যমে মানুষের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুন। মানুষের সাথে মিশতে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে তা চিহ্নিত করুন এবং সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করুন।
২১. নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করুন এবং দলের নেতাকে অনুসরণ ও মেনে চলার সক্ষমতা তৈরি করুন।
২২. আসর জমানোর দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করুন।
২৩. সাম্প্রতিক ও প্রচলিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা রাখুন।
তানজির আহম্মদ তুষার : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়