ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হলে কী হয়
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/04/04/photo-1459773514.jpg)
ডায়াবেটিস রোগীদের অনেক সময় ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বা স্নায়ুর সমস্যা হয়। এনটিভির প্রতিদিনকার আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৪৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন। বর্তমানে তিনি ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ ও বারডেমের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বিষয়টি কী?
উত্তর: নিউরোপ্যাথি মানে স্নায়ুর সমস্যা। ডায়াবেটিস হলে যেসব জটিলতা হয় এর একটি হলো স্নায়ুর সমস্যা। ডায়াবেটিসের জটিলতাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। একটি ম্যাক্রোভাসকুলার, আরেকটি মাইক্রোভাসকুলার। এই মাইক্রোভাসকুলার জটিলতার একটি হলো নিউরোপ্যাথি।
তিনটি জিনিস হয়। একটি স্নায়ুর সমস্যা, আরেকটি রেটিনা বা চোখের সমস্যা, আরেকটি কিডনির সমস্যা। এই তিনটিকে একসঙ্গে মাইক্রোভাসকুলার কমপ্লিকেশন অব ডায়াবেটিস বলা হয়। একজনের যদি নিউরোপ্যাথি হয়, তাহলে র্যাটিনোপ্যাথি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আবার যদি র্যাটিনোপ্যাথি হয়, তার ন্যাপ্রোপ্যাথি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত।
এখন যদি নিউরোপ্যাথির কথা বলি, নিউরোপ্যাথি মানে স্নায়ুর সমস্যা। স্নায়ু কিন্তু দুটো। একটি সেন্ট্রাল নার্ভ, আরেকটি পেরিফেরাল নার্ভ। ডায়াবেটিস হলে সাধারণত সেন্ট্রাল নার্ভে সমস্যা হয় না।
মানে, মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা হয় না। যা হয় সব পেরিফেরাল নার্ভে। পেরিফেরাল নার্ভ আবার কয়েক ভাগে হয়। একটি মটর, আরেকটি সেনসরি, আরেকটি অটোনমিক।
ডায়াবেটিসে অটোনমিকের সমস্যা বেশি। সেনসরি ও মটর দুটো একসঙ্গে বেশি হয়।
সেনসরি হলো, মানুষের সেনসেশন (বোধশক্তি)। কারো ব্যথা কম, কারো ব্যথা বেশি। কারো ব্যথা পরিবর্তিত হয়। ঝিন ঝিন করে, জ্বলে যায়, পুড়ে যায়। কারো বলে ব্যথা বেশি হয়।
যেমন : একজন হয়তো বলে, ‘আমি রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় খড়কুটোর ওপর দিয়ে হাঁটলাম।’ আবার আরেকজন বলে, ‘আমি পাথরের ওপরে হেঁটে যাচ্ছি।’ কেউ কেউ বলে, ‘হাঁটার সময় আমার পা থেকে স্যান্ডেল পড়ে গেল, আমি টের পেলাম না।’
এমন অনেক সময় হয়, রাতে শুয়ে আছে, তবে তার ঘুম আসছে না। কী ব্যাপার? পা জ্বলছে।
আবার এমনও অভিযোগ করে, হয়তো রোগী বলছে আমার কম্বলের নিচে আগুন লেগে গেছে- এমন মনে হলো। কম্বল তুলে দেখে আগুন নেই। মানে তার পা জ্বলছে। সে হয়তো কিছুক্ষণ পর শুয়ে পড়েছে।
আবার জ্বলছে। হয়তো সে বিছানার পাশে বালতিতে পানি রেখে, সেখানে পা ডুবিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এ রকম জ্বলতে পারে এবং জ্বলে। এটা হলো সেনসেশনের (বোধশক্তি) সমস্যা।
মটরের ক্ষেত্রে কী সমস্যা হয়? দুর্বলতা হয়। তবে প্যারালাইসিস হয় না। অনেকেই ভয় পায়, ডায়াবেটিস হলে প্যারালাইসিস হয় কি না? না প্যারালাইসিস হয় না। প্যারালাইসিস হতে হলে তো স্ট্রোক করতে হবে। দুটো পায়ের যদি স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে হাঁটায় সমস্যা হতে পারে। তবে এটি খুব কম। এখানে দুর্বলতা বেশি হয়।
আরেকটি হলো পায়ের স্নায়ুর সমস্যার জন্য পায়ে আলসার হয়, ঘা হয়। আলসারটা কেবল স্নায়ুর জন্য হয় না। পায়ের স্নায়ুর জন্য যদি সমস্যা হয়, তাহলে পায়ের তলায় হয়। আর যদি আর্টারি, ধমনির জন্য হয়, তাহলে পায়ের ওপরে হয়। একে অনেকে ডায়াবেটিস আলসার বলে। এটা গেল সেনসরি ও মটর।
আরেকটি রয়েছে অটোনমিক নিউরোপ্যাথি। ডায়াবেটিস রোগী এলেই বলে তার গ্যাসের সমস্যা হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত সমস্যা এটি। গ্যাসট্রিকের ওষুধ খায়। তবে ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়। ডায়াবেটিস হলে পাকস্থলীর মুখ ঢিলা হয়। একে বলে গ্যাসট্রোপ্যারিসিস। এটি একটি প্রচলিত সমস্যা। এটি হলো অটোনমিক নিউরোপ্যাথির একটি সমস্যা। এরপর ডায়রিয়া হয়। এমনি ডায়ারিয়া হলে, সকাল বেলা বা দিনের প্রথমার্ধে সমস্যা হয়। তবে ডায়াবেটিস হলে, রাত্রে ডায়রিয়া হয়।
আরেকটি হয় যৌন সমস্যা। তবে অনেক ক্ষেত্রে যৌন সমস্যাগুলো মানসিক কারণে হয়। তাই এরকম সমস্যা হলে আগে দেখতে হবে তার মানসিক সমস্যা আছে কি না। আবার যৌন সমস্যাটাও অটোনমিক নিউরোপ্যাথির মধ্যে পড়ে।
প্রশ্ন : এগুলো সবই কি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে আসে?
উত্তর : হ্যাঁ। সত্য কথা হলো, এটি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত থাকলে, ভালো থাকার সম্ভাবনা বেশি এবং থাকেও। আর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে জটিলতা বেশি হয়। তাই আপনি যতই চিকিৎসা নেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করে তো লাভ নেই। কারণ উৎসটাই তো ডায়াবেটিস।
আমরা হয়তো কথাগুলো খুব সহজেই বলছি। তবে আসলেই যার জটিলতা হয়, তার সমস্যাটা কিন্তু অনেক। জীবন একেবারে দুর্বিসহ হয়ে যায়। আমরা তো রোগী দেখি, জানি, এটা বড় ধরনের সমস্যা। এর চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে যায়।
ডায়াবেটিস হয়তো নিয়ন্ত্রণ করলেন, এরপরও সমস্যা কমছে না। আপনি ওষুধ দিলেন, গাবা পেনটিন, প্রি গাবা, অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ, প্যারাসিটামল দিলেন, এনএসআইএড দিলেন, ভিটামিন দিলেন- কিছুতেই বিষয়টি কমতে চায় না। কিন্তু আবার অনেকেরই কমে যায় এবং অনেকে ভালো জীবনযাপন করতে পারে। সে জন্য ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। কমে যেতে অন্তত আপনাকে দু-তিন মাস চিকিৎসা নিতে হবে।
আরেকটি জিনিস বলি, এই সমস্যা নির্ণয়ের জন্য কোনো টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না। খামাখা পয়সা খরচের দরকার নেই। এমনিতেই বোঝা যায়। আর এটা প্রতিরোধেরও বিষয় আছে।
সব চিকিৎসকই যাঁরা ডায়াবেটিস রোগী দেখেন, তাঁরা দেখবেন রোগীর পায়ে হাত দেয়। পায়ে হাত দেওয়ার কারণ একটিই। রক্তনালি দেখা, আর স্নায়ু ঠিকমতো আছে কি না দেখা। আর পায়ের ত্বক দেখলেও বোঝা যায়, নিউরোপ্যাথি হয়েছে, ভাসকুলার রোগ হয়েছে। তাই প্রথম থেকে যদি বলে দেন, অন্তত পায়ের আলসারটা প্রতিরোধ করা যাবে।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের আলসার প্রতিরোধে কী কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : যার পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হলো, যার পায়ে বোধ কম আছে, তাকে প্রথম কথা বলতে হবে যে ‘তুমি এমন কিছু করবে না, যাতে পায়ে খোঁচা লাগে। যে কোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ, একবার যদি খোঁচা লাগে, একবার যদি সংক্রমণ হয়, সেটি সারানো কঠিন। কারণ রক্ত পরিবহন নেই, আপনি কীভাবে সংক্রমণ সারাবেন? স্নায়ুর পরিবহন নেই আপনি কীভাবে ঠিক করবেন? সে জন্য পায়ে যেন খোঁচা না লাগে, ধাক্কা না লাগে এটি খেয়াল রাখতে হবে। আর জুতা যেটি পরা হয় সেটি যেন ভালোভাবে লাগে। যদি কড়া বা কেলাস পড়ে যায় তাহলে আলসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রতিরোধ হলো সবচেয়ে বড় জিনিস।
আমরা প্রথমেই বলে দিই, আপনি আর তো কিছু করতে পারবেন না। অন্তত পায়ে যেন খোঁচা না লাগে সেটি খেয়াল করবেন।
আবার আরেকটি বিষয় হলো যাদের ওজন বেশি, তাদের দুই আঙুলের মধ্যে পানি জমে, ফাঙ্গাস হয়। ওই ফাঙ্গাসের চিকিৎসাও কঠিন। ডায়াবেটিস তো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। পাশাপাশি ওই জায়গায় যেন পানি না জমে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পা শুকনো রাখতে পারলে এটি হবে না।
প্রশ্ন : রোগ হয়ে গেলে চিকিৎসার কী কী ব্যবস্থা রয়েছে?
উত্তর : স্নায়ুর যদি সেনসেশন (বোধশক্তি) সমস্যা হয়, দুটো জিনিস হয় বোধশক্তি কমে যায় বা বেড়ে যায়। বোধশক্তি বেড়ে গেলে সেটি কমানো যায়। তবে যার বোধশক্তি কমে গেছে, তার ক্ষেত্রে কিছু করার নেই; প্রতিরোধই করতে হবে।
ডায়াবেটিসে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের আগে থেকেই এই জিনিসগুলো মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে যদি আপনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সেন্টারগুলোতে যান, যখন রেজিস্ট্রেশন করা হয়, আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে এগুলো বলার জন্য। এগুলো শেখানোর জন্য। যদি তাও না পারেন, ডায়াবেটিক সমিতির বইটি নিয়ে পড়তে পারেন।
ডায়াবেটিস রোগী নিজেই নিজের বড় ডাক্তার। কারণ সে প্রতিদিন ভুগছে। ডাক্তারের চেয়ে তার বেশি জানা দরকার।