চোখের গ্লুকোমার চিকিৎসা কী?

গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪৩৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান। বর্তমানে তিনি ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : গ্লুকোমা হয় কেন? এই রোগটি কী?
উত্তর : গ্লুকোমা রোগটি এতই উপসর্গহীন রোগ যে উপসর্গ বুঝতে পারার আগেই রোগী অন্ধ হয়ে যায়। গ্লুকোমার বিভিন্ন কারণ আছে। তবে এর বেশির ভাগই হচ্ছে জেনেটিক কারণ। বংশগত কারণ যাদের থাকে, তাদের মধ্যেই বয়সের একটি পর্যায়ে গিয়ে গ্লুকোমা হয়। তবে গ্লুকোমা আসলে একটি রোগ নয়। বেশির ভাগ সময় যেই গ্লুকোমাটা বোঝা যায় না, একে বলি ‘ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা’। ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্মগত কারণেই থাকে। এর পর বয়স বাড়তে বাড়তে একসময় প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : গ্লুকোমায় আসলে চোখের ভেতর কী ঘটে? চোখের কোন অংশে কী ক্ষতি হয়?
উত্তর : আমাদের চোখের যে গঠন, এখানে সামনের অংশে থাকে কর্নিয়া। আইরিস, লেন্স, আরো ভেতরে গিয়ে রেটিনা এবং চোখের অপটিক নার্ভ। গ্লুকোমায় ক্ষতি হয় অপটিক নার্ভের। অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। পেছনের কারণ কাজ করে, চোখের ভেতরে অভ্যন্তরীণ চাপ তৈরি করে। এই চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হলো এর যে রক্ত চলাচলের পথটা, এটা ক্রমে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। এই চলাচলের পথটি থাকে চোখের সামনের অংশে। কর্নিয়ার ঠিক পেছনেই। একে আমরা অ্যাঙ্গেল বলি। এখান থেকেই চোখের ভেতরের যে পানি, এটা যেতে যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে চাপ বাড়তে থাকে।
প্রশ্ন : চোখের চাপ বাড়ার কারণে কী ক্ষতি হয়?
উত্তর : এই চাপ যদি বাড়ে, তাহলে অপটিক নার্ভের যে জৈব প্রক্রিয়া এটা ক্রমে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। অর্থাৎ যেই স্নায়ু দিয়ে আমরা দেখতে পাই, অর্থাৎ চোখের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগের যেই স্নায়ু, এটি হলো অপটিক নার্ভ। এখানে প্রায় ১২ মিলিয়ন আঁশ আছে। এই আঁশগুলো একে একে ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে থাকে। প্রথমে বাইরের দিকেরগুলো, চারদিকেরগুলো, আস্তে আস্তে ক্রমশ কেন্দ্রেরগুলো নষ্ট হতে শুরু করে। এ জন্য গ্লুকোমা রোগীর প্রথমে চারদিকের শক্তিটা কমতে থাকে। সে মনে করে, আমি তো দেখছি। হ্যাঁ, সে সোজাসুজি সব দেখতে পায়, চারপাশ থেকে দৃষ্টি শক্তির ক্ষেত্রটা কমে আসে। সাধারণত ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি না হলে রোগী নিজে বুঝতে পারে না। অনেকে এসে অভিযোগ করে যে আমি হাঁটতে যাচ্ছি, পাশে হাতে আঘাত লাগছে বুঝতে পারছি না। যাঁরা গাড়ি চালান, খুব সচেতন, তাঁরা বুঝতে পারেন আমি সামনে দেখছি, তবে পাশের আয়নায় কিছু দেখতে পাচ্ছি না। পাশের দিক থেকে ক্ষতি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। যাঁরা একটু কম সচেতন বা নিজে গাড়ি চালান না, তাদের প্রথম প্রথম এই সমস্যাগুলো ধরা পড়ে না। যখন ধরা পড়ে, তার প্রায় ৫০ ভাগেরও বেশি স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এটা কখনোই আর ভালো করা যায় না।
প্রশ্ন : যেহেতু সেই স্নায়ুটিকে আগের অবস্থায় আর ফিরিয়ে আনা যায় না, তাহলে চিকিৎসা করে কী সুবিধা হয়? কী করণীয়?
উত্তর : আসলে চিকিৎসাটি হলো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার মতো। আগুনে যা পুড়ে যায় সেটি তো আমরা ফেরত পাই না। তবে দমকল বাহিনী আরো ক্ষতি হওয়া থেকে বিষয়টিকে রক্ষা করে। একটি রোগীর যখন গ্লুকোমা হয়, তখন চিকিৎসার করার পরও তার দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। তবে আমাদের লক্ষ্য হলো আমৃত্যু সে যেন চোখে দেখে। সে যেন অন্ধ হয়ে না যায়। সে যেন অচল হয়ে না পড়ে। এই চিকিৎসাগুলো আমরা করি ধাপে ধাপে। প্রথমে আমরা তাকে ওষুধ দিই। এরপর প্রয়োজন হলে ওষুধের সংখ্যা বাড়াই। মাত্রা বাড়াই। তাতেও যদি তার চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে না আসে, প্রয়োজনে আমরা অস্ত্রোপচার করি। অস্ত্রোপচারে নানা রকম বিষয় আছে। কার ক্ষেত্রে কেমন প্রয়োজন, সেভাবে আমরা বুঝে বুঝে করি। এভাবে সাধারণত চিকিৎসা করলে এটি আটকানো যায়। একে থামিয়ে রাখা যায়। বেশির ভাগ রোগীরটাই থেমে থাকে। পুরোপুরি থামিয়ে রাখা যায়। অথবা ক্ষতি হলে এত ধীরে হবে যে তার আয়ুষ্কাল যত দিন, তত দিনে যেন পুরোপুরি অন্ধ হয়ে না যায়।
প্রশ্ন : এর সার্জারির কখন প্রয়োজন হয়?
উত্তর : সার্জারির ক্ষেত্রে সাধারণত যেটি ওপেল অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, ধীরগতির রোগ, এর উপসর্গ থাকে না, প্রথমে আমরা দেখি যে চোখের প্রেশার কেমন। সাধারণত স্বাভাবিক চাপ হলো ১০ মিলিমিটার মার্কারি থেকে ২০ মিলিমিটার মার্কারি। এটা হচ্ছে স্বাভাবিক মাত্রা। এর ওপরে যদি চলে যায়, সাধারণত আমরা পর্যবেক্ষণে রাখি। কিছু ওষুধ দিয়ে দিই। এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করতে হয়। এরপর পরীক্ষা করি তাকে। ভিজ্যুয়াল ফিল্ড। এই ফিল্ড পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখি যেই পর্যন্ত সেটি ঠিক আছে। যদি কিছু সমস্যা দেখা দেয়, তখন আমরা তিন বা ছয় মাস পর আবার একটি ওষুধ বাড়িয়ে দিয়ে, আবার তিন মাস বা ছয় মাস পড়ে আবার পরীক্ষা করি। যদি দেখা যায়, ভিজ্যুয়াল ফিল্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন এই চাপ আরো কমাতে হবে। তখন আমরা আরো ওষুধ যোগ করি। এভাবে তিন থেকে পাঁচটি পর্যন্ত ওষুধ আমরা দিতে পারি। কিন্তু একসময় যদি আমরা দেখি ওষুধ দেওয়ার পরও আস্তে আস্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাহলে আমরা সার্জারির সিদ্ধান্ত নিই। গ্লুকোমার ওষুধগুলো একটু ব্যয়বহুল। বছরের পর বছর দিতে হয়। ওষুধের ব্যয় বহন করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার অনেক রোগী হয়তো ঠিকমতো ওষুধ দিতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্ত নিই অস্ত্রোপচার করার। অস্ত্রোপচার করে কিন্তু গ্লুকোমা ফেলে দেওয়া হয় না। অস্ত্রোপচার একটিই কাজ করে, চোখের চাপকে কম রাখে। চাপটা স্বাভাবিক থাকলে তার বাকি অপটিক নার্ভগুলো জীবনভর ঠিক থাকে।
প্রশ্ন : গ্লুকোমার কারণে যদি একজন মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, তার কী কর্নিয়া সংযোজন করে চিকিৎসা করার কোনো আশা থাকে?
উত্তর : না, এ রকম কোনো সংযোজন করা যায় না। সিনেমার ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যায়, ‘স্যার আমার মা যদি চোখ দান করে আমি দেখতে পাব কি না?’ আসলে চক্ষুদান সম্পর্কে আমাদের সমাজে এক ধরনের ভুল ধারণা আছে। গ্লুকোমার বেলায় আসলে এটি করা যায় না। মানুষের কর্নিয়া নষ্ট হলে অন্য লোকের মৃতদেহ থেকে কর্নিয়া নিয়ে এলে এটি সংযোজন করা যায়। গ্লুকোমায় আর কিছু করা যায় না।