বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার কী?

‘বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার’ বা দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য একটি গুরুতর মানসিক রোগ। ‘বাই’ শব্দের অর্থ ‘দুই’ আর ‘পোলার’ হলো মাথা বা দিক। এই রোগের দুটি দিক থাকে। একদিকে থাকে ‘ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা’, অপরদিকে থাকে ‘ম্যানিক কন্ডিশন’। একদিকে যেমন বিষণ্ণতা কাজ করে, আরেকদিকে কাজ করে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস। শুনতে খুব সমস্যাদায়ক মনে না হলেও বিষয়টি খুবই গুরুতর। এ রোগটি নিয়ে বিস্তারিত জেনে রাখুন।
শুরুর কথা
যুগে যুগে এই রোগটি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের ভাবিয়েছে। সতেরো শতকের শেষের দিকে থিওফিলাস বোনেট এই রোগকে ম্যানিকো মেলাংকোলিকাস নামে চিহ্নিত করেন। এরপর ১৮৫১ সালে ফরাসি মনোচিকিৎসক জ্যঁ পিয়ের ফালরেট তাঁর বইয়ে ম্যানিয়া ও বিষণ্ণতা আন্তপরিবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিত লেখেন। এটি বাইপোলার রোগের প্রথম নির্ণয়ের দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া ক্রেপলিনও (১৯২১) এই রোগের শ্রেণিবিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে জার্মান মনোচিকিৎসক কার্ল লিওনার্দো ও তাঁর সহযোগীরা ১৯৫০ সালে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারকে ভালোভাবে বোঝা ও চিকিৎসা করার জন্য উপযুক্ত প্রথম পেশাগত শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি প্রস্তুত করে। ১৯৮০ সালে বাইপোলার শব্দটি ব্যবহার করে রোগটিকে চিহ্নিত করা হয় আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসওর্ডার-এ।
বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার কী
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মদ তুষার জানান, এটি একটি তীব্র মানসিক রোগ, যাকে বাংলায় বলা হয় দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য। এই রোগে বিষণ্ণতা (দীর্ঘদিন ধরে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যদি কারো মন খারাপ থাকে বা কষ্ট লাগার অনুভূতি হয় তবে তাকে বিষণ্ণতা বলে) রোগের সমস্ত উপসর্গ দেখা যায়। এর একদিকে অতিরিক্ত আনন্দ অনুভূত হয়, অন্যদিকে বিষাদে মন ছেয়ে যায়। একদিকে ব্যক্তি প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভোগে, বেশির ভাগ সময়ই মন খারাপ থাকে। অন্যদিকে ম্যানিক কন্ডিশনের কারণে ব্যক্তি নিজেকে অনেক বড় মনে করতে থাকে, অতি আনন্দ অনুভব করে, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অনুভব করে। এ ছাড়া সব কিছুতেই অতিরিক্ত অস্থিরতা কাজ করে। তবে দুটি দিক থাকলেও রোগ একটিই।
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রির এক রিপোর্টে বলা হয়, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শতকরা ৬০ ভাগ বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ দেখা দেয় কৈশোরে বা তার আগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাইপোলার ডিজঅর্ডার সারা বিশ্বে ষষ্ঠ অক্ষমতার কারণ।
উপসর্গ
এ রোগের উপসর্গ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলোজিস্ট তানজির আহম্মদ তুষার জানান, এই রোগের একদিকে বিষণ্ণতা রোগের প্রায় অধিকাংশ লক্ষণগুলোই দেখা যায়। বিষণ্ণতার লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায় অনেক দিন ধরে মন খারাপ থাকা, কোনো কাজে আগ্রহ না পাওয়া, আনন্দের অনুভূতি কমে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া বা বেশি ঘুমানো, ঘুম ভেঙে মনে হওয়া আরেকটি খারাপ দিন শুরু হলো, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, কাজে মনোযোগের অভাব, অহেতুক কোনো কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ করা, ভালোবাসা বা যৌনতার অনুভূতি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হওয়া, খাবার ইচ্ছা কমে যাওয়া বা খুব বেশি খেতে ইচ্ছে করা, শারীরিক কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে মাথাব্যথা থাকা ইত্যাদি।
অন্যদিকে, ব্যক্তি অস্বাভাবিক আনন্দ অনুভব করে। তখন তার মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ভাব কাজ করে। দ্রুত এবং অতিরিক্ত কথা বলে। ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। নিজেকে অনেক শক্তিশালী মনে করে, অস্থির থাকে। ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। কেউ কেউ অতিরিক্ত যৌন চাহিদা অনুভব করে। অবাস্তব পরিকল্পনা করে। অতিরিক্ত টাকা-পয়সা খরচ করে বা কেনাকাটা করতে চায়। সমাজের বিভিন্ন নিয়মকানুন পরিবর্তনে নিজেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মনে করে। বিচার করার ক্ষমতা ঠিকমতো থাকে না। কাজের ফলাফল কী হবে তা না ভেবেই বিভিন্ন কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অভ্র দাস ভৌমিক বলেন, রোগী ভাবে তাকে অনেক কাজ করতে হবে। তার ঘুমানোর দরকার নেই। কথা এত বেশি বলে যে মাঝে মাঝে কথার খেই হারিয়ে ফেলে। সে বিশাল ব্ড় স্বপ্ন দেখে। তবে বিষণ্ণতা রোগে ব্যক্তি কাজে মনোযোগ দিতে পারে না, এখানে দিতে পারে। ব্যক্তি মনে করে তার খাওয়ার দরকার নেই বা ঘুমের দরকার নেই। যেন অনেক শক্তি ও ক্ষমতা এসে ব্যক্তিটির ওপর ভর করেছে। আবার কখনো অবসাদ এত গভীর হয় যে আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। কিছু ক্ষেত্রে একটি মিশ্র অবস্থাও দেখা যায়। মেজাজ পরিবর্তিত হতে থাকে এবং চরম রূপ ধারণ করে, যা ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর হয়।
কারণ
এই রোগের কারণ এখনো নির্দিষ্ট করে এবং পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, কিছু জেনিটিক্যাল (জিনগত) ও বায়োলজিক্যাল (জৈবিক) পরিবর্তনের কারণে এই রোগ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া অস্বাভাবিক মস্তিষ্কের গঠনের কারণে এ রোগ হতে পারে। নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তনের কারণেও অনেক ক্ষেত্রে এটি হতে পারে। আবার জেনেটিক এবং বায়োলজিক্যাল কারণের পাশাপাশি পরিবেশের বিভিন্ন কারণেও এই রোগ হয়।
এ রোগে বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও বলেন তানজির আহম্মদ তুষার। রোগীর ক্ষেত্রে মেজাজের চক্রাকার ওঠানামা দীর্ঘসময় ধরে চলে এবং গুরুতর অবস্থা ধারণ করে। এর ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটে। স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে অসুবিধা হয়, লেখাপড়ায় সমস্যা হয়, আগ্রাসী আচরণ করে, কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অনেকে আত্মহত্যা করে ফেলে।
চিকিৎসা
মনোবিশেষজ্ঞ অভ্র দাস ভৌমিক বলেন, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে ম্যানিক এবং বিষণ্ণতা দুটো বিষয়ের একসঙ্গে চিকিৎসা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
এ ক্ষেত্রে মুড স্ট্যাবিলাইজার জাতীয় ওষুধ দিতে হয়। মেজাজ স্বাভাবিক রাখার জন্য এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। বিষণ্ণতা অথবা ম্যানিক পর্যায়, কোনোদিকই যেন রোগীকে পেয়ে না বসে, মনকে মাঝখানে ধরে রাখতে এই ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিষণ্ণতায় আক্রান্ত মনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার জন্য অ্যান্টিডিপ্রেশন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ম্যানিক পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ রোগীকে সেবন করতে দেওয়া হয়। অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধগুলো ম্যানিয়া থেকে নামিয়ে বিষণ্ণতার পর্যায়ে নিয়ে আসে। তখন মুড স্ট্যাবিলাইজার ব্যবহার করা হয়। মুড স্ট্যাবিলাইজার জাতীয় ওষুধ তিন থেকে পাঁচ বছর খেতে হয়।
ম্যানিয়া তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। বিষণ্ণতা এক মাস থেকে ছয় মাস থাকে। বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি নিলে অনেকে সুস্থ হয়। তবে প্রয়োজন হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ওষুধ খাওয়ার এক মাসের মধ্যে ভালো অবস্থায় চলে আসে।
এই চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো বিষণ্ণতার কারণে অতি খারাপ মনকে ভালোর দিকে আনা এবং ‘অতি ভালো’ থাকা মন বা ম্যানিক পর্যায়ের মনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা জানিয়ে তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, এ রোগে সাইক্রিয়াট্রিস্ট-এর কাছে পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। রোগটি যাতে আর ফিরে না আসে তার জন্য ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে পরামর্শ বা সাইকোথেরাপি নিতে হবে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা রোগীকে নিজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে শেখান এবং রোগটি যাতে বেড়ে না যায় এ জন্য করণীয় পদ্ধতি শেখান।
নিজেকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত রাখার উপায়
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, এ ধরনের সমস্যা হলে নিজেকে সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ম্যানিক পর্যায়ে চলে গেলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। কথা কম বলতে হবে। শান্ত নিরিবিলি জায়গায় থাকার চেষ্টা করতে হবে। বাইরে বা কেনাকাটা করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। ফোনে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কথা কম বলতে হবে। সব ধরনের অতিসক্রিয়তা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। একই সাথে অতি আত্মবিশ্বাসটি তাঁর নিজের নয় বরং রোগের তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
পারিবারিক দায়িত্ব
এ রকম সমস্যা রোগীর প্রতি পরিবারের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন, পারিবারিক সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। লোকলজ্জার ভয়ে না থেকে ব্যক্তিকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এতে করে ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরা রোগটি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য বা নির্দেশনা পাবে এবং কখন কী করতে হবে সেসব বিষয়ে সচেতন হতে পারবে। পরিবারকে বোঝাতে হবে এবং নিয়মিত রোগীকে ওষুধ খাওয়াতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। রোগীর অতি আত্মবিশ্বাস বা অহংকারমূলক কথাগুলো রোগের কারণে রোগী বলছে তা বুঝে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে হবে।