জেলায় জেলায় ডেঙ্গুর আতঙ্ক, বাড়ছে রোগী ও মৃতের সংখ্যা

রাজধানী ঢাকাকে ছাড়িয়ে ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকটি জেলা ইতোমধ্যেই ডেঙ্গুর হটস্পটে পরিণত হয়েছে, যেখানে রোগী ও মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও প্রস্তুতি না থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
সারাদেশে ডেঙ্গুর চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছায় হাজার ৪৬৬ জনে। এর মধ্যে ৩০ জন মারা গেছেন। উদ্বেগজনকভাবে, দেশের ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে, কিন্তু ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও তেমন কার্যকর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ডেঙ্গুর হটস্পট জেলা
দেশের ১১টি জেলা এখন ডেঙ্গুর সর্বাধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। বিভাগওয়ারি হিসাবে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে, যার সংখ্যা দুই হাজার ৯৮০ জন। সেখানে ৮ জন মারা গেছেন।
এই বছরের ডেঙ্গু সংক্রমণের দিক থেকে শীর্ষে থাকা জেলাগুলো হলো :
বরগুনা : এ জেলায় এক হাজার ৮৩২ জন আক্রান্ত (মোট রোগীর ২৮ শতাংশ), মৃতের সংখ্যা পাঁচ জন। দুই মাস আগেও এখানে রোগী ছিল মাত্র ১২৮ জন।
ঢাকা : রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৪৭২ জন (মোট রোগীর ২৩ শতাংশ)।
বরিশাল : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭৫ জন। মারা গেছেন ৩ জন।
পটুয়াখালী : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭৯ জন।
চট্টগ্রাম : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩১২ জন।
কুমিল্লা : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২০৪ জন। মারা গেছেন ৩ জন।
গাজীপুর : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৭ জন।
কক্সবাজার : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৪ জন।
মাদারীপুর : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩ জন।
পিরোজপুর : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১১৯ জন।
চাঁদপুর : এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১১১ জন।
এই ১১টি জেলায় মোট পাঁচ হাজার ৩৯৮ জন রোগী পাওয়া গেছে, যা মোট রোগীর ৮৩ শতাংশ। বাকি ৪৮ জেলায় এক হাজার ৬৮ জন রোগী রয়েছেন। এ তথ্য মঙ্গলবার (১৮ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী করা।

গত ২৪ ঘণ্টায় বুধবার (১৮ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৬ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৩ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৭ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৩ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জন রয়েছেন। এ সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৮৯ জন ডেঙ্গুরোগী।
বরগুনাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবার ডেঙ্গুর হটস্পট ঘোষণা করেছে। বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ জানান, সুপেয় পানির অভাবে মানুষ বৃষ্টির পানি চৌবাচ্চা বা প্লাস্টিকের ড্রামে সংরক্ষণ করে, যা এডিস মশার লার্ভার প্রধান প্রজননস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার হাসপাতালে ২৫০টি বেডের বিপরীতে চারগুণ রোগী ভর্তি আছে, মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন হওয়ায় হাসপাতালের ভেতরেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। তিনি আইসিইউ সুবিধার অভাবের কথাও উল্লেখ করেন।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা ডেঙ্গুর রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই একটি উপজেলার কারণেই পুরো কুমিল্লা জেলা ডেঙ্গুর শীর্ষ জেলাগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত এই উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। বিশেষ করে পৌরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে হটস্পট ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বছর জানুয়ারি থেকেই দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। জানুয়ারিতে এক হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কিছুটা কমলেও এপ্রিল থেকে আবার বাড়তে থাকে। মে মাসে এক হাজার ৭৭৩ জন ও জুনের ১৭ দিনে দুই ১২১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রস্তুতির অভাব ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, সামনে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম। গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা কেন্দ্রিক কাজ করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে সব জায়গায়ই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র। ফলে এখন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর এডিস মশার প্রজননের জন্য ঢাকার বাইরেও দালান কোঠা, ভবন আছে। আমরা সেগুলোকে গুরুত্ব দেইনি। আর জেলা বা উপজেলার হাসপাতালগুলোর এত রোগী সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নেই। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ নাই।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘গত বছরেই আমরা বলেছিলাম বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। এর কারণ হলো, আমরা জরিপ করতে গিয়ে দেখেছি প্রাদুর্ভাব হওয়ার তিনটি উপাদান হোস্ট (মানুষ), প্যাথোজেন (ডেঙ্গু ভাইরাস) ও এনভায়রনমেন্ট (এডিস মশার প্রজননের উপযোগী পরিবেশ)—এই তিনটিই অনুকূলে ছিল। তখনই আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু নেওয়া হয়নি।’
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারির পর এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এবার এখন পর্যন্ত ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। কিন্তু এডিস মশা প্রতিরোধে ঢাকাসহ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ নেই। আর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগও তেমন কার্যকর নয়। আসলে আমাদের সমন্বিত কোনো ব্যবস্থাপনাই নাই।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।