হঠাৎ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে যে চার ধরনের জ্বর

জ্বর বিভিন্ন কারণে হয়। ভাইরাসের কারণে জ্বর হয়, আবার ব্যাকটেরিয়ার কারণেও জ্বর হয়। সাধারণত জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার দিন তিনেকের মধ্যে সেটি ভালোও হয়ে যায় এবং এর জন্য খুব জটিল চিকিৎসার দরকার হয় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালযয়ের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, জ্বর আসলে কোন রোগ নয়। এটি অন্য কোন রোগের লক্ষণ মাত্র। সবচেয়ে সাধারণভাবে বলা যায়, দেহে কোন জীবাণুর সংক্রমণ হলে জ্বর হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমণে জ্বরে ভোগ মানুষ।
কোনো জ্বরই আসলে অবহেলা করা উচিত নয়। উপসর্গ বুঝে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিশেষ করে যদি জ্বরের সাথে আরো অন্য কোন উপসর্গ থাকে এবং এক সপ্তাহর পরও সেটি ভালো না হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। সেই সাথে যারা শিশু, বয়স্ক এবং ক্রনিক কোন রোগ বা আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে তাদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
জ্বরের সাথে ঘাড় বা শরীরের ব্যথা, উচ্চ তাপমাত্রা, বমি করা বা খাবার খেতে না পারা, তিনদিনের বেশি জ্বর থাকা, শুধু রাতে জ্বর আসা, শরীরে র্যাশ বের হওয়া, চোখ শুকিয়ে যাওয়া, খিচুনি হওয়া-ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
কিছু কিছু জ্বর রয়েছে যা অনেক সময় প্রাণঘাতি হয়েও দেখা দিতে পারে। এগুলো হচ্ছে-
ডেঙ্গু
দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু মৌসুম চলছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, আগস্টে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ২০৩ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১৮ জন। সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ৩৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩৮৯ জন, বাকি ৯৮৫ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগের।
এজন্য এই মৌসুমে কারো জ্বর হলে, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, শরীর ব্যথা যদি থাকে তাহলে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার কথা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ডেঙ্গু রোগীদের শরীরের যে কোন জায়গা থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ মানেই তা হেমারেজিক ডেঙ্গুতে রূপ নিয়েছে। হেমারেজিক ডেঙ্গুতে চোখে রক্ত জমে যায়; নাক, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ঝরে; মুখ, কান, মলদ্বার এরকম যেকোনো একটি বা একের অধিক অংশ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। বমি ও কাশির সাথেও রক্ত বের হতে পারে।
ইয়োলো ফিভার বা হলুদ জ্বর
ইয়োলো ফিভার বা হলুদ জ্বর মশার কামড়ে ছড়ায় এবং এই মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এডিস এবং হেমাগোগাস মশার কামড়ে এই জ্বর ছড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, হলুদ জ্বরে লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাংসপেশী ব্যথা, মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব বা বমি। সাধারণত ৩-৬ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে খুবই কম সংখ্যক রোগী এই জ্বরে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক এসব উপসর্গ থেকে সেরে ওঠার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে পৌছায়।
এই ধাপে, শরীরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেড়ে যায় এবং আবারো জ্বর আসে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে লিভার এবং কিডনি আক্রান্ত হয়। এই ধাপে মানুষ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। শরীরের ত্বক এবং চোখে হলুদ হয়ে যায়।
এ কারণেই একে ইয়োলো ফিভার বা হলুদ জ্বর বলা হয়। এ অবস্থায় মূত্র গাঢ় রঙের হয়, পেট ব্যথা এবং বমি হয়। মুখ, নাক, চোখ বা পেটে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেসব রোগী এই ধাপে পৌঁছায় তাদের মধ্যে অর্ধেকই ৭-১০ দিনের মধ্যে মারা যায়।
এই জ্বর নিরোধক কোনো ওষুধ নেই। তবে এটি টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়।
ম্যালেরিয়া
কারো যদি জ্বর থাকে এবং জ্বরের সাথে সাথে ঠান্ডা, মাথাব্যথা, ক্লান্তিভাব, বিভ্রান্তি, খিঁচুনি ও নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তাহলে দেরি না করে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কারণ এসব লক্ষণ প্রাণঘাতি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে এ ধরণের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
অ্যানোফিলিস নামে এক ধরণের স্ত্রী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে বা তার ব্যবহৃত সুঁচ ব্যবহারের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। প্রাথমিক উপসর্গগুলো সাধারণ জ্বর আক্রান্তের মতোই মৃদু হয় এবং ম্যালেরিয়া বলে সনাক্ত করাও কঠিন। তবে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারে।
ম্যালেরিয়া একটি প্রাণঘাতি রোগ এবং এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোতে বেশি সংক্রমিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় লাখ ১৯ হাজারের বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
৫ বছরের কম বয়সী শিশু, গর্ভবতী নারী, সফরে থাকা ব্যক্তি এবং এইচআইভি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে।
টাইফয়েড জ্বর
টাইফয়েডের অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে উচ্চমাত্রায় জ্বর। এ ছাড়া প্রচণ্ড ক্লান্তি, মাথাব্যথা, বমি, পেট ব্যথা, আমাশয় এবং ডায়রিয়াও থাকে। জ্বরের সঙ্গে এ ধরনের উপসর্গ অনেক সময় প্রাণঘাতি হয়। তাই চিকিৎসকের এ ধরণের উপসর্গ দেখলে চিকিৎসকের কাছে নেয়ার পরামর্শ দেন।
টাইফয়েডে আক্রান্ত অনেক রোগীর দেহে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। এটি মারাত্মক আকার ধারণ করলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর এক লাখ ১০ হাজার মানুষ বিশ্বজুড়ে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর আক্রান্ত হয় ৯০ লাখের বেশি মানুষ।
সালমোনেলা টাইফি নামে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে টাইফয়েড ছড়ায় যা প্রাণঘাতি একটি রোগ। এই ব্যাকটেরিয়া একবার শরীরে ঢুকে পড়লে তা বিভাজিত হতে থাকে এবং এটি রক্তে মিশে যায়। সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে এটি ছড়ায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে টাইফয়েড সনাক্ত করা যায়।