নিজ গ্রামে হাজারো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হামজা চৌধুরী

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলার হামজা চৌধুরী তার পৈতৃক বাড়িতে এলেন এবং হাজারো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হলেন। সোমবার (১৭ মার্চ) বিকেল ৩টায় বাহুবলের নিভৃত জননপদ ‘স্নানঘাট’গ্রামে প্রবেশ করে তাকে বহণকারী গাড়িবহর। সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা সিলেট আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে নামেন। সেখান থেকে হামজা চৌধুরীকে একটি হুডখোলা গাড়িতে করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আগামী ২৫ মার্চ বাংলাদেশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলবেন তিনি।
সোমবার সেহরি খাওয়ার পর থেকেই মূলত লোকজন আসতে শুরু করে হামজা চৌধুরীদের গ্রামের বাড়িতে। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে ইট-সিমেন্টের প্রাচীরে ঘেরা বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সেখানে নারী, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ ছিলেন। সবাই উদগ্রীব; কখন দেখা মিলবে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সেই টগবগে তরুণ তুর্কির। এক সময় প্রহর গোনা শেষ হয়। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেস্টনির মধ্য দিয়ে তিনি বাড়িতে প্রবেশ করেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন তাকে একনজর দেখার জন্য। এক পর্যায়ে জনমানুষের এ স্রোত স্বেচ্ছাসেবী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আর সামাল দিতে পারে না। এ অবস্থায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভক্ত, অনুরাগী, পাড়াপ্রতিবেশী, স্বজন-পরিজনরা ফুলের তোড়া দিয়ে এবং ফুল ছিটিয়ে তাকে বরণ করে নেন। এ সময় ‘হামজা’ ‘হামজা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে বাড়ি ও আশপাশের এলাকা। হামজা চৌধুরী তখন ‘আই প্রাউড’, ‘ইমেজিং’ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ বলে সমবেত লোকজনের ভালবাসার জবাব দেন।
বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে তার জন্য বাড়ির উঠানে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে কথা বলার জন্য তাকে তোলা হয়। এ সময় ‘হামজা’, ‘হামজা’ স্লোগান দিতে দিতে বাঁধ ভাঙা মানুষের ঢল আছড়ে পড়ে ছোট্ট মঞ্চের ওপর। আয়োজকরা এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে থাকেন। এসময় লোকজনকে আশপাশের বাড়িঘরের ছাদ, চাল ও গাছের ডালে ঝুলে উঁকি দিয়ে হামজা চৌধুরীকে দেখার চেষ্টা দেখা যায়। সব বাঁধা ঠেলে বিপুল মানুষ মঞ্চের ওপর উঠে পড়লে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এ অবস্থায় মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে হামজা চৌধুরী সবার উদ্দেশে কথা বলেন, “আসসালামুআলাইকুম, আমার খুব ভালা লাগছে, আপনারা হকলে আইছন আমারে দেখার লাগি।”একথা বলে তিনি “বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ”বলে স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় সমবেত লোকজনও তার সাথে সাথে স্লোগানে স্লোগানে দেশপ্রেমের আবহ তৈরি করেন। এক পর্যায়ে সবাইকে ইংরেজিতে অভিবাদন জানিয়ে তার ও বাংলাদেশ ফুটবল দলের ভারত জয়ের জন্য দোয়া চেয়ে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় কথা বলা শেষ করেন। এ সময় সমবেত লোকজন “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ”বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
শেষ বিকেলে বাড়ির এক কোণে স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবের নামাঙ্কিত ও বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে কিছু শিশু-কিশোরকে স্লোগান দিতে দেখা যায়। তাদের একজন আসলাম মিয়া। এ কিশোরকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “টিভি ও মোবাইলফোনের স্ক্রিনে আমরার এলাকার পোলা হামজার খেলা দেখছি। আজকু তারে দাড় (কাছে) তাইক্যা দেখবার লাইগ্যা আইছি।”তুমি ভবিষ্যতে কি হতে চাও জিজ্ঞাস করলে তার সোজা উত্তর, “হামজা, ফুটবলার হামজা হইতাম চাই।”
কথা হয় বাহুবল উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি ও স্থানীয় আলিফ-সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক এম. শামছুদ্দিন-এর সাথে। এম শামছুদ্দিন বলেন, “আজকে হামজা চৌধুরীকে দেখতে আসা মানুষের ঢল ফুটবল ও ফুটবলারের প্রতি মানুষের ভালবাসার নিদর্শন। এ দৃশ্য আমার মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে যে, এবার বাংলাদেশ ফুটবল আকাশে সোনালী সূর্য দেখা দেবে। হামজা চৌধুরীর অভিষেকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলে গণজাগরণ সৃষ্টি হবে। তার ও বাংলাদেশ ফুটবল দলের জন্য শুভ কামনা রইল।”
এর আগে হামজা চৌধুরীকে বহনকারী গাড়িবহর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী বাজারে পৌঁছালে সেখান থেকে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার মাধ্যমে তাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় লোকজন হাত উঁচিয়ে এবং ফুল ছিটিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। তিনিও হুডখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে স্থানীয় লোকজনকে জবাব দেন।
হামজা চৌধুরীর পরিবারের লোকজন জানান, হামজা চৌধুরীকে এক নজর দেখতে বাহুবল তথা হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজার হাজার লোকজনকে ছোট এ বাড়িতে বাসার বা দাঁড়ানোর সুব্যবস্থা করতে না পারায় আমরা দুঃখিত। তবে, এ বিপুল পরিমাণ মানুষের উপস্থিতি জাতীয় দলে ভাল খেলতে ও দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে তাকে (হামজা চৌধুরী) উৎসাহিত করবে, যা দেশের ফুটবলে গণজাগরণ সৃষ্টি করবে বলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন। পরিবারের লোকজন আরও জানান, হামজা চৌধুরী ও তার সঙ্গীরা দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টা যাবত বিশ্রামহীন অবস্থায় আছেন। তিনি তার আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের সাথে একান্তে কিছু সময় কাটিয়ে বিশ্রাম নেবেন। তিনি মঙ্গলবার মধ্যাহ্ন পর্যন্ত এখানে থাকবেন।
সোমবার (১৭ মার্চ) সকাল ১১টা ৩৫ দিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে হামজা চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। এর আগে রোববার দিনগত রাত বাংলাদেশ সময় ২টায় যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন হামজা।
বাংলাদেশের জার্সিতে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামার জন্য প্রথমবারের মতো দেশে এসে ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন হামজা চৌধুরী। তার আগমন ঘিরে সিলেট বিমানবন্দরে ভিড় জমান শত শত ভক্ত-সমর্থক। হামজা ও তার পরিবারকে বরণ করে নিতে সিলেটে এসেছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
হামজার আগমনে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়ও ছিল লক্ষ্যণীয়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন এই ইংলিশ ফুটবলার। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় খুব বেশি কিছু বলতে পারেননি হামজা চৌধুরী। পরে সেখান থেকে আবার বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকে যান।
বাফুফে সদস্যরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর থেকে ফুটবলার হামজা পৈতৃক বাড়ি বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামে যান। সেখান থেকে আগামীকাল মঙ্গলবার ঢাকা যাবেন। এরপর একদিন প্র্যাকটিস করবেন।
এদিকে, হামজাকে স্বচক্ষে এক নজর দেখার জন্য সিলেট বিমানবন্দরের বাইরে অনেক সমর্থকের ভিড়। কেউ ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, কেউ আবার খালি হাতে শুধু এক নজর দেখার জন্য। এসময় তারা বিভিন্ন স্লোগান ও মিছিল দিতে থাকেন।